শুক্রবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২২

এরউইন শ্রোডিঞ্জার ও কোয়ান্টাম তরঙ্গ-গতিবিদ্যা - Erwin Schrödinger and Quantum Mechanics

 

এরউইন শ্রোডিঞ্জার এবং কোয়ান্টাম তরঙ্গ গতিবিদ্যা - Erwin Schrödinger and Quantum Mechanics
এরউইন শ্রোডিঞ্জার এবং কোয়ান্টাম তরঙ্গ গতিবিদ্যা - Erwin Schrödinger and Quantum Mechanics

এরউইন শ্রোডিঞ্জার : কোয়ান্টাম তরঙ্গ-গতিবিদ্যার জনক - Erwin Schrödinger and Quantum Mechanics

এরউইন শ্রোডিঞ্জার (Erwin Rudolf Josef Alexander Schrödinger) এর জন্ম ১৮৮৭ সালে ভিয়েনার এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে, যেখানে তাঁর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল গ্রিকসাহিত্যের এবং বিটোফেন-মোজার্টের সঙ্গীতের। সমসাময়িকদের অনেকের মতোই শ্রোডিঞ্জার প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে সেনাদলে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর শিক্ষকতার জীবনে ফিরে এসে জেনা, স্টুটগার্ট আর বিসউতে কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি জুরিখে অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তার আগে অধ্যাপক ছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। এখান থেকে তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে যে অতুলনীয় অবদান রাখেন তাই তাঁকে এবং পি. এ. এম. ডিরাককে ১৯৩৩ সালের নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছিল।

হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঞ্জার আর ডিরাকের কোয়ান্টাম গতিবিদ্যাকে একটা বিশাল বিপ্লব বলা হয়েছে। রাজনীতিতে বিপ্লবের একটা ধরাবাধা ছক থাকে--- এক পদ্ধতি বাতিল হয়ে সেখানে নতুন আরেক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানে এটা কখনই হয় না। প্রেমের অর্থ যেমন বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন, বিজ্ঞানের বিপ্লবও তাই। সংবাদপত্রসেবী এবং পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিজ্ঞান-বিপ্লব সম্বন্ধে ধারণা এক নাও হতে পারে। তবু বিপ্লবী সম্বন্ধে দুটো ধারণা বোধহয় সকলেই মেনে নেবেন। প্রথমত নতুন জ্ঞানের আলোকে বিজ্ঞানের কোন কোন অংশ বাতিল করার জন্যে দরকার এ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা। দ্বিতীয়ত পুরনো ইমারতের কোন কোন অংশের সঙ্গে নতুন গড়া কাঠামোর সমন্বয় সাধন প্রয়োজন সে সম্বন্ধে অন্তত প্রথম দিকে একটা অস্পষ্ট ধারণা।

১৯০০ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞানের এক সুদীর্ঘ ক্রান্তিকাল। এ সময়ে ছয়টি বৈপ্লবিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে : প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব (১৯০০); আইনস্টাইনের আলোক-কোয়ান্টাম প্রস্তাব (১৯০৫); হাইড্রোজেন পরমাণুর বোর তত্ত্ব (১৯১৩); সত্যেন বসুর কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান (১৯২৪); হাইসেনবার্গের মেট্রিক্স গতিবিজ্ঞান (১৯২৫) এবং শ্রোডিঞ্জারের তরঙ্গ গতিবিজ্ঞান (১৯২৬)। এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে সাধারণ সূত্র একটাই এবং তা হলো প্রত্যেকটি মধ্যে এমন একটি তাত্ত্বিক পদক্ষেপ রয়েছে, যার কোনো ব্যাখ্যা লেখকের জানা ছিল না। অনুপ্রাণিত অনুমানের সাহায্যেই লেখক নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। ১৯২৫ থেকে ১৯২৭ এই সময়কালকে বলে বালকদের পদার্থবিজ্ঞানের সময়। ১৯২৫ সালে হাইসেনবার্গের বয়স ২৩; জর্ডানের বয়স ২২; পাউলির ২৫; ডিরাকের ২২। শ্রোডিঞ্জারকে ঠিক এই দলে ফেলা যায় না, কেননা তার বয়স তখন ৩৭। সৃজনশীল কর্মজীবনের শেষের দিকে যেন এক প্রচণ্ড সৃষ্টির উন্মাদনায় শ্রোডিঞ্জার তাঁর জীবনের মহত্তম কাজটি করে গিয়েছেন। ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে কাজ করে শ্রোডিঞ্জার সুখী ছিলেন না। কেননা, তিনি লিখেছেন, সুইসরা বিশেষ অন্তরঙ্গ নয়।

অস্ট্রিয়ার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ফিরে যাওয়াই তাঁর ইচ্ছা, কিন্তু ইসক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেতন নিয়ে কথাবার্তা সন্তোষজনক না হওয়ায় সেখানে আর ভর যাওয়া হলো না। এর ঠিক আঠারো মাস পরেই তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের উত্তরাধিকারী হয়ে যেতে পেরেছিলেন। ১৯২৫ সালের শরৎকালে শ্রোডিঞ্জার শুধু যে সুইসদের ব্যাপারেই অসুখী ছিলেন তাই নয়, তিনি হাইজেনবার্গ, বর্ন আর জর্ডানের মেট্রিক্স পদ্ধতি নিয়েও মানসিক পীড়ায় ভুগছিলেন। তিনি লিখেছেন, ওই বিশেষ শক্ত আর অপ্রাকৃত বীজগণিত যা মানসিকভাবে চিত্রায়িত করা যায় না, তা দেখে আমি হতাশ হয়েছিলাম, কিন্তু একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেইনি।

সুতরাং তিনি তার সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ দূর করতে চাইলেন পারমাণবিক গতিবিদ্যায় এক নতুন পদ্ধতির সৃষ্টি করে, যা হাইসেনবার্গের মেট্রিক্স পদ্ধতির সত্যিকারের বিকল্প হবে।

কোয়ান্টাম তরঙ্গ গতিবিদ্যা আবিষ্কারের ঠিক আগে আইনস্টাইনের গ্যাসতত্ত্ব নামে যে প্রবন্ধ তিনি লেখেন, সেখান থেকেই নতুন পথের যাত্রা শুরু। মনে রাখতে হবে, সুদূর ঢাকা থেকে সত্যেন বসু প্ল্যাঙ্কের সমীকরণ নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বাতলে দিয়েছিলেন সেটাই ব্যবহার করে আইনস্টাইন ভরবিশিষ্ট বস্তুকণার গ্যাসতত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলেন।

কিন্তু শ্রোডিঞ্জার বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান (Bose–Einstein (B–E) statistics) বিশেষ পছন্দ করেননি। তাঁর কথা হলো এই যে, নতুন কোনো পরিসংখ্যান প্রয়োজনই হয় না, যখন গ্যাসের অণুকে তরঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সুতরাং তিনি লিখেছেন, এর একমাত্র অর্থ হবে চলমান বস্তুকণার জন্য আইনস্টাইন দ্য-ব্রগলির (Louis Victor Pierre Raymond, 7th Duc de Broglie) তরঙ্গতত্ত্ব গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া।  

এটাই শ্রোডিঞ্জার সার্থকভাবে করেছিলেন। তাঁর এই বিষয়ে প্রবন্ধটি প্রকাশকের কাছে পৌঁছায় ২৭ জানুয়ারি, ১৯২৬ এবং এই প্রবন্ধেই রয়েছে তার বিখ্যাত হাইড্রোজেন পরমাণুর সমীকরণ, যা এখন পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিটি ছাত্রের কণ্ঠস্থ। এখান থেকেই কোয়ান্টাম তরঙ্গ-গতিবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু, যা এ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধু বিজয়ই অর্জন করেছে।

শ্রোডিঞ্জার তাঁর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের চারটি প্রবন্ধে যে তরঙ্গ-গতিবিজ্ঞান উদ্ভাবন করেন তাই আজকাল সব পদার্থবিজ্ঞানী ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি তার তৃতীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করার আগে একটি আনুষ্ঠানিক গাণিতিক রূপান্তর আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে তাঁর এবং হাইসেনবার্গের পদ্ধতির যে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ প্রমাণ করা যায়।

পরমাণুর শক্তি স্তর সম্বন্ধে শ্রোডিঞ্জারের সমীকরণ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া গেলেও প্রথম থেকেই এই প্রশ্নই বারবার উঠেছে যে, এই তত্ত্বের জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? ম্যাক্স বর্ন এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, শ্রোডিঞ্জারের তরঙ্গ-অপেক্ষক দেশকাল মহাকাশে বস্তুকণার অবস্থানের সম্ভাবনা-প্রসার নির্দেশ করে। শ্রোডিঞ্জার (এবং আইনস্টাইন) এই সম্ভাবনার ধারণার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের স্রষ্টাদের মধ্যে এঁরাই বোধ হয় দুজন, যাঁরা তাঁদের নিজের সৃষ্টির সঙ্গে শান্তিতে কোনোদিনই বাস করতে পারেননি। এঁরা দুজনই প্রকৃতিকে কার্যকারণসম্মত অবিচ্ছিন্ন ধারার ঘটনা পরম্পরা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন এবং তাই শ্রোডিঞ্জার বলেছিলেন, আমার মনেই হয় না যে, ইলেকট্রন মাছির মতো লাফিয়ে বেড়ায়।

১৯২৬ সালে তার ভুবনবিখ্যাত কাজের সময় থেকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি সম্ভাবনাভিত্তিক ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে গেছেন। আইনস্টাইনকে লিখেছেন আজকাল সম্ভাবনার ধারাটিকে অত্যন্ত অসঙ্গতভাবে ব্যবহার করা হয়। অবশ্যই সম্ভাবনার অর্থ এই যে, কোনো কিছু ঘটে, কি ঘটে না। এই বক্তব্যের তাৎপর্য থাকে শুধু তখনই, যখন আমরা বাস্তবিকই বিশ্বাস করি যে, বিচার্য বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ঘটে, কি ঘটে না। একটা সম্ভাবনাভিত্তিক দাবির অর্থই হলো তার বিষয়বস্তুর সম্পূর্ণ বাস্তবতা সম্বন্ধে পূর্ব ধারণা।.... কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিজ্ঞানীরা অনেক সময় এমন আচরণ করেন যাতে মনে হয় যে সম্ভাবনাভিত্তিক বক্তব্য প্রয়োগ করা প্রয়োজন সেই সব ঘটনায় যার বাস্তবতাই অস্পষ্ট।

আইনস্টাইন উত্তরে লিখেছিলেন এটা (সম্ভাবনাভিত্তিক ব্যাখ্যা) সত্য হলে পদার্থবিজ্ঞান শুধু দোকানদার এবং প্রকৌশলীদেরই আগ্রহ সৃষ্টি করবে এবং সব ব্যাপারই হয়ে যাবে একটা নোংরা জগাখিচুড়ি।

দোকানদার আর প্রকৌশলীদের এই নোংরা জগাখিচুড়ির বিরুদ্ধেই ১৯৩৫ সালে শ্রোডিঞ্জার তার বিখ্যাত বিড়ালের মানস পরীক্ষার উদ্ভাবন করেছিলেন। একটি বাক্সের মধ্যে আবদ্ধ বিড়ালের শতকরা পঞ্চাশভাগ সম্ভাবনা থাকে যে সে জীবিত কিনা এবং বিড়ালের তরঙ্গ-অপেক্ষক জীবন্ত বিড়াল আর মৃত বিড়ালের দুই সম্ভাব্য অবস্থারই যোগফল। মার্জার প্রহেলিকার মূল কথা হলো এই যে, যখন কোনো অনুসন্ধানী টম বাক্সটি খুলে দেখতে চায় যে, বিড়ালের সঠিক অবস্থাটা কী, তখন হঠাৎই বিড়াল হয় মৃত, না হয় জীবন্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এ কথাই বলতে হয় যে, দর্শকই চূড়ান্ত পর্যায়ে বিড়ালটিকে হত্যা করে। এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর।

সারা জীবন শ্রোডিঞ্জার একাকী কাজ করে গিয়েছেন। হিটলারের নাৎসিরা ক্ষমতা দখল করার পর তিনি জার্মানির অত্যন্ত সম্মানজনক অধ্যাপক পদে ইস্তফা দিয়ে অক্সফোর্ডে একটি সামান্য ফেলোশিপ নিয়ে চলে যান ১৯৩৩ সালেই।

১৯৪১ সালে তিনি আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইমন দ্য ভ্যালেরার আমন্ত্রণে ডাবলিনে নবপ্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এখানকার অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশে তিনি বই লেখার কাজেও হাত দিয়েছিলেন। এ সময়ে তার লেখা জীবন কী?' গ্রন্থটি আজও পদার্থবিজ্ঞানীদের মনে সম্ভ্রম জাগায়; তার নিজের সমীকরণের জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে তিনি কোনোদিনই সন্তুষ্ট ছিলেন না, কিন্তু ১৯২৬ সালের মতো তিনি আর মঞ্চের কেন্দ্রে কোনোদিনই ফিরে আসতে পারেননি। তার সৃষ্ট কোয়ান্টাম তরঙ্গবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা এখনও এক বিরাট প্রশ্ন হিসেবেই রয়ে গিয়েছে--যে প্রশ্নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন