রবিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২২

অ্যাকোয়া রিজিয়া, লুকানো নোবেল মেডেল ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো - Aqua regia, Nobel prize medals and fooling the Nazi forces

 

অ্যাকোয়া রিজিয়া, লুকানো নোবেল মেডেল ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো  - Max von Laue and James Franck - Aqua regia, Nobel prize medals and fooling the Nazi forces
অ্যাকোয়া রিজিয়া, লুকানো নোবেল মেডেল ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো  - Max von Laue and James Franck - Aqua regia, Nobel prize medals and fooling the Nazi forces


অ্যাকোয়া রিজিয়া, লুকানো নোবেল মেডেল ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো- Aqua regia, Nobel prize medals and fooling the Nazi forces

চারদিকে যুদ্ধের ঘনঘটা। সময়টা ১৯৪০ সাল। ইউরোপে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান সেনাবাহিনী দখল করে নিচ্ছে দেশের পর দেশ। বিশেষ করে ইহুদিদের জন্য সময়টা ছিল খুব খারাপ। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দলটি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইহুদিদের দমন করার জন্য নানা রকমের চেষ্টা চালাচ্ছিল। খুন খারাপি তো আছেই, নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে পুরো দেশের সব ইহুদিদের অথবা অনেককেই ধরে ঢোকানো হচ্ছিল গ্যাস চেম্বারে। জার্মানির বিজ্ঞানী সমাজের অনেকেই ছিলেন ধর্ম বা বংশগতভাবে ইহুদি। বাঘা বাঘা সব নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কেবল ইহুদি হওয়ার জন্য চাকরি হারিয়েছেন, বের করে দেওয়া হয়েছে তাদের জার্মানি থেকে, অথবা নিজেরাই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন বিদেশে। আবার অনেকে নাৎসিদের অত্যাচারের বিরোধিতা করে হিটলারের চক্ষুশূল হয়েছেন। এমনই দুই বিজ্ঞানী হলেন ম্যাক্স ফন লাউই, যিনি ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, আর জেমস ফ্র্যাংক, যিনি পদার্থে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯২৫ সালে। ফ্র্যাংক হলেন ইহুদি, আর ফন লাউই ইহুদি না হলেও নাৎসিদের বিরোধিতার কারণে হয়েছেন তাদের শত্রু। দুজনের কাছেই ছিল নোবেল পুরস্কারের অংশ হিসেবে পাওয়া সোনার মেডেল। তাতে তাদের নাম আর পুরস্কারের সালটা খোদাই করা। হিটলারের নাৎসি সরকার সেই সময়ে স্বর্ণ কাছে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর ইহুদি কারও কাছে সোনা পেলে তো কথাই নাই। সরাসরি ফায়ারিং স্কোয়াড কিংবা গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হবে।

অ্যাকোয়া রিজিয়া, লুকানো নোবেল মেডেল ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো - Aqua regia, Nobel prize medals and fooling the Nazi forces
অ্যাকোয়া রিজিয়া, লুকানো নোবেল মেডেল ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো - Aqua regia, Nobel prize medals and fooling the Nazi forces

ম্যাক্স ফন লাউই (বাঁয়ে) (Max Theodor Felix von Laue) এবং জেমস ফ্রাংক (James Franck) (ডানে)

হিটলারের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে ফ্রাংক পালিয়ে গেছেন আমেরিকায়। সেখানে কাজ করছেন হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর গোপন প্রজেক্টে। পালানোর আগে সোনার মেডেলটা পাঠিয়ে দিয়েছেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। সেখানে আছে আরেক পদার্থবিদ ১৯২২ সালের নোবেলজয়ী নীলস বোরের (Niels Bohr) গবেষণাগার। বোর তখনো পালিয়ে যাননি। তবে ডেনমার্ক ১৯৪০ সাল নাগাদ জার্মানদের দখলে চলে গেছে। বোর তাই বেশ সতর্ক পুরো ব্যাপার নিয়ে। আর সতর্ক কেন হবেন না, তার কাছে নোবেল মেডেল একটা না। ফ্রাংকেরটা তো আছেই, কিছুদিন আগে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাউইও তার মেডেলটা পাঠিয়ে দিয়েছেন বোরের কাছে, নিরাপদে রাখার জন্য। কাছে থাকলে জার্মান পুলিশ গেস্টাপোর গুণ্ডারা এসে ছিনিয়ে নেবে, তাই বোরের কাছে রাখাই ভালো মনে করেছেন।

বোর পড়ে গেলেন বেশ চিন্তায়। জার্মানরা তো তখন ডেনমার্কের সর্বত্র তল্লাশি চালাচ্ছে। সবাই জানে, নীলস বোর নিজে খ্রিষ্টান হলেও ইহুদি অনেক বিজ্ঞানীকে সাহায্য করেছেন। মেডেলগুলোসহ ধরা পড়লে তাঁকেও জার্মানরা মেরে ফেলবে নির্ঘাত। কী করা যায়? বোরের সহকর্মী ছিলেন জর্জ দ্য হেভেসি নামের আর এক রসায়নবিদ। তার সাথেই আলোচনায় বসলেন। হেভেসি শুরুতে আইডিয়া দিলেন, মেডেল দুটোকে বাগানে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখার। কিন্তু বোর একমত হলেন না। জার্মান সেনারা গাধা না। তারা তল্লাশিতে এলে সব খুঁড়ে দেখবে বটে। তাহলে উপায়?

হেভেসি অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর ইউরেকা! সমাধানটা তো খুব সহজ! এতক্ষণ মাথায় আসেনি বলে হেভেসি হেসে ফেললেন একটু। তো, কী আইডিয়া পেলেন? জার্মানেরা খুঁজবে সোনার তৈরি মেডেল। যদি মেডেলের আকারে কিছু না পায়, তাহলেই তো বিপদ থেকে মিলবে মুক্তি। কিন্তু কীভাবে লুকানো যায় মেডেলগুলো? তাপে গলিয়ে ফেলে সোনার বিস্কুট বানালে লাভ নাই। জার্মানরা সোনা পেলে কেড়ে নেবে। হেভেসির সমাধানটা খুব সহজমেডেলগুলোর সোনাকে তরল কোনো দ্রবণে দ্রবীভূত করে রাখলেই চলবে। জার্মান সেনারা তরল কিছুতে সোনা আছে, সেটা বুঝবে না।।

George de Hevesy - Fooling the nazis -জর্জ দ্যা হেভেসি -  হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো
George de Hevesy - Fooling the nazis -জর্জ দ্যা হেভেসি -  হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো

জর্জ ডি হেভেসি (George De Hevesy)

ব্যাপারটা আসলে কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। সোনা খুব নিষ্ক্রিয় একটি ধাতু। সে কারণেই সোনায় মরিচা পড়ে না, জং ধরে না, বিবর্ণ হয় না সোনা। এমনকি সব রকমের অ্যাসিড যেমন কড়া সালফিউরিক অ্যাসিডেও সোনার তেমন কিছু হয় না। তবে আছে, একটা তরল আছে, যা সোনার শত্রু। তিন ভাগ হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড আর এক ভাগ নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণএকে বলা হয় অ্যাকোয়া রিজিয়া বা রাজকীয় তরল (Aqua regia)। কারণ হলো এই মিশ্রণে সোনার কিছু ফেললে সেটা গলে যায়। এতই কড়া এই অ্যাসিড।

হেভেসির মাথায় যে আইডিয়াটা এসেছিল, তা এইটাই, নোবেল মেডেলগুলোকে এই অ্যাসিড মিশ্রণে ডুবিয়ে দিয়ে গলিয়ে ফেলবেন। মেডেলের সোনা দ্রবীভূত হয়ে থাকবে এই তরলে। পরে যুদ্ধ থামলে সোনাটুকুকে উদ্ধার করে নেওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। জার্মান নাৎসি সেনাবাহিনী ধেয়ে আসছে খবর পাওয়া মাত্র এক বিকেলে হেভেসি বসলেন এক বিকার ভর্তি অ্যাকোয়া রিজিয়া অ্যাসিড মিশ্রণ আর মেডেল দুটো নিয়ে। দুরুদুরু বুকে ডুবিয়ে দিলেন মেডেলগুলোকে সেই দ্রবণে। আস্তে আস্তে তার চোখের সামনে মিলিয়ে গেল সোনার মেডেলগুলো। দ্রবণটির রং প্রায় বর্ণহীন। একটু সোনালি আভা আছে এই যা। দেখে কেউ বুঝবে না এর মাঝে একটা নয়; বরং দুই-দুইটি সোনার মেডেল দ্রবীভূত হয়ে আছে।

যা আশঙ্কা করেছিলেন বোর আর হেভেসি, কয়দিন পরে সেটাই সত্যি হলো। জার্মানরা হানা দিল বোরের গবেষণাগার। কিন্তু আঁতিপাতি করে খুঁজেও তারা কিছুতেই মেডেলগুলো পেল না। বোর আর হেভেসি গম্ভীর মুখ করে থাকলেও মনে মনে অট্টহাসি হাসছিলেন সারাক্ষণ। কারণ মেডেলগুলো আসলে জার্মানদের ঠিক নাকের ডগাতেই রাখা আছে। বিকারভর্তি অ্যাকোয়া রিজিয়া তরলে দ্রবীভূত মেডেলগুলো গবেষণাগারের তাকে রাখা, কিন্তু জার্মান সেনারা বুঝতেই পারেনি এই সোনালি আভার তরলটি আসলে সোনার দ্রবণ।

যুদ্ধের পুরো সময় এই মেডেলের দ্রবণটা সেখানেই ছিল। ১৯৪৩ সালে হেভেসি নিজেই পালিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডে। যুদ্ধ শেষ হলো ১৯৪৫ সালে। হেভেসি ফিরলেন কোপেনহেগেনে, হাজির হলেন গবেষণাগারে। অবাক হয়ে দেখলেন, সেই বিকারটা নোবেল মেডেলের দ্রবণসহ দিব্যি আছে সেই তাকে। অ্যাকোয়া রিজিয়া দ্রবণে কিছু রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে উদ্ধার করা হলো মেডেলের সোনাটুকু। ১৯৫০ সালে নীলস বোর নিজের হাতে সেই সোনা পৌঁছে দিলেন সুইডেনের স্টকহোমের রয়াল সুইডিশ বিজ্ঞান একাডেমিতে। সেই সোনা দিয়ে আবার বানানো হলো মেডেল দুটো। ১৯৫২ সালে বিজ্ঞানী দুজনকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো তাদের সেই সোনার নোবেল মেডেল।

Tags: অ্যাকোয়া রিজিয়া বা রাজকীয় তরল, লুকানো নোবেল মেডেল, হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে বোকা বানানো, Aqua regia,Nobel prize medals, fooling the Nazi forces 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন