বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

সায়েন্স ফিকশন - প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু - সত্যজিৎ রায় - Professor Shonku and Robu - Satyajit Ray

 

সায়েন্স ফিকশন,প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু,সত্যজিৎ রায়,Professor Shonku and Robu,Satyajit Ray,science fiction

সায়েন্স ফিকশন - প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু - সত্যজিৎ রায় - Professor Shonku and Robu - Satyajit Ray ১ম পর্ব (২ পর্ব)
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - 
১৬ই এপ্রিল
আজ জার্মানি থেকে আমার চিঠির উত্তরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর পমারের চিঠি পেয়েছি। পমার লিখেছেন-
প্রিয় প্রোফেসর শঙ্কু,

তোমার তৈরি রোবো বা যান্ত্রিক মানুষ সম্বন্ধে তুমি যা লিখেছ, তাতে আমার যত না আনন্দ হয়েছে, তার চেয়েও বেশি হয়েছে বিস্ময়। তুমি লিখেছ আমার রোবো সম্পর্কে গবেষণামূলক লেখা তুমি পড়েছ, আর তা থেকে তুমি অনেক জ্ঞানলাভ করেছ। কিন্তু তোমার রোবো যদি সত্যিই তোমার বর্ণনার মতো হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে যে আমার কীর্তিকে তুমি অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছ।

আমার বয়স হয়েছে, তাই আমার পক্ষে ভারতবর্ষে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তুমি যদি একটিবার তোমার তৈরি মানুষটিকে নিয়ে আমার এদিকে আসতে পার, তাহলে আমি খুশিই হব না, আমার উপকারও হবে; এই হাইডেলবার্গেই আমারই পরিচিত আরেকটি বৈজ্ঞানিক আছেন- ডক্টর বোর্গেল্ট। তিনিও রোবো নিয়ে কিছু কাজ করেছেন। হয়তো তার সঙ্গেও তোমার লাপ করিয়ে দিতে পারব।

তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। যদি আসতে রাজি থাক, তাহলে একদিকের ভাড়াটার আমি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করে দিতে পারব। আমার এখানেই তোমার থাকার ব্যবস্থা হবে, বলাই বাহুল্য।

ইতি,

রুডলফ পমার



পমারের চিঠির উত্তর আজই দিয়ে দিয়েছি। বলেছি আগামী মাসের মাঝামাঝি আসব। ভাড়ার ব্যাপারে আর আপত্তি করলাম না, কারণ বিমানে যাতায়াতের খরচা কম নয়, অথচ ওদেশটা দেখার লোভও আছে যথেষ্ট।

আমার রোবু সঙ্গে যাবে অবশ্যই, তবে ও এখনো বাংলা আর ইংরেজি ছাড়া কিছু বলতে পারে না। এই এক মাসে জার্মানটা শিখিয়ে নিলে ও সরাসরি পমারের সঙ্গে কথা বলতে পারবে, আমাকে আর দোভাষীর কাজ করতে হবে না।

রোবুকে তৈরী করতে আমার স্ময় লেগেছে দেড় বছর। আমার চাকর সবসময় আমার পাশে থেকে জিনিসপত্র এগিয়ে-টেগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে, কিন্তু আসল কাজটা সমস্ত আমি নিজেই করেছিআর যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, সেটা হচ্ছে রোবুকে তৈরি করার খরচ। সবশুদ্ধ মিলিয়ে খরচ পড়েছে মাত্র তিনশ তেত্রিশ টাকা সাড়ে সাত আনা এই সামান্য টাকায় যে জিনিসটা তৈরি হলো সেটা ভবিষ্যতে হবে আমার ল্যাবরেটরির সমস্ত কাজে আমার সহকারী, যাকে বলে রাইট হ্যান্ড ম্যান। সাধারণ যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের অঙ্ক করতে রোবুর লাগে এক সেকেন্ডের কম সময় এমন কোনো কঠিন অঙ্ক নেই যেটা করতে ওর দশ সেকেন্ডের বেশি লাগবে এ থেকে বোঝা যাবে আমি জলের দরে কী এক আশ্চর্য জিনিস পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি" বলছি এই জন্যে যে, কোনো বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকেই আমি সম্পূর্ণ মানুষের সৃষ্টি বলে মনে করতে পারি না। সন্ভাবনাটা আগে থেকেই থাকে, হয়তো চিরকালই ছিল; মানুষ কেবল হয় বুদ্ধির জোরে না হয় ঈশ্বর প্রদত্ত ভাগ্যবলে সেই সন্ভাবনা গুলোর হদিস পেয়ে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নেয়

রোবুর চেহারাটা যে খুব সুশ্রী হয়েছে তা বলতে পারি না বিশেষ করে দুটো চোখ দু রকম হয়ে যাওয়াতে ট্যারা বলে মনে হয়। সেটাকে ব্যালান্স করার জন্য আমি রোবুর মুখে একটা হাসি দিয়ে দিয়েছি। যতই কঠিন অঙ্ক করুক না সে-হাসিটা ওর মুখে সব সময় লেগে থাকে। মুখের জায়গায় একটা ফুটো দিয়েছি, কথাবার্তা সব এ ফুটো দিয়ে বেরোয়। ঠোট নাড়ার ব্যাপারটা করতে গেলে অযথা সময় আর খরচ বেড়ে যেতো তাই ওদিকে আর যাইনি।

মানুষের যেখানে ব্রেন থাকে, সেখানে রোবুর আছে একগাদা ইলেকট্রিক তার, ব্যাটারি, বাল্ভ ইত্যাদি। কাজেই ব্রেন যা কাজ করে তার অনেকগুলোই রোবু পারে না। যেমন সুখ-দুঃখ অনুভব করা বা কারুর ওপর রাগ করা বা হিংসে করা- এসব রোবু জানেই না। ও কেবল কাজ করে আর প্রশ্নের উত্তর দেয় অঙ্ক সব রকমই পারে, তবে শেখানো কাজের বাইরে কাজ করে না, আর শেখানো প্রশ্নের জবাব ছাড়া কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না ঞ্চাশ হাজার ইংরেজি আর বাংলা প্রশ্নের উত্তর ওকে শিখিয়েছি- একদিনও ভুল করেনি। এবার হাজার দশেক জার্মান প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দিলেই আমি জার্মানি যাবার জন্য তৈরি হয়ে যাব।

এত অভাব থেকে রোবু যা করে তা পৃথিবীর আর কোনো যান্ত্রিক মানুষ করেছে বলে মনে হয় না। এমন একটা জিনিস সৃষ্টি করে ঢাকা শহরের মধ্যে সেটাকে বন্দী করে রাখার কি কোনো মানে হয়? বাংলাদেশে সামান্য রসদে বাঙালি বৈজ্ঞানিক কী করতে পারে, সেটা কি বাইরের জগতের জানা উচিত নয়? এতে নিজের প্রচারের চেয়ে দেশের প্রচার বেশি। অন্তত আমার উদ্দেশ্য সেটাই



১৮ই এপ্রিল

এত দিনে অবিনাশবাবু আমার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা স্বীকার করলেন আমার এই প্রতিবেশীটি ভালো মানুষ হলেও, আমার কাজ নিয়ে তাঁর ঠাট্টার ব্যাপারটা মাঝে মাঝে বরদাস্ত করা মুশকিল হয়

উনি প্রায়ই আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসেন কিন্তু গত তিন মাসের মধ্যে যতবারই এসেছেন, ততবারই আমি মাজেদকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছি যে আমি ব্যস্ত, দেখা হবে না

আজ রোবুকে জার্মান শিখিয়ে আমার ল্যাবরেটরির চেয়ারে বসে একটা বিজ্ঞান পত্রিকার পাতা উল্টোচ্ছি, এমন সময় উনি এসে হাজির। আমার নিজেরও ইচ্ছে ছিল উনি একবার রোবুকে দেখেন, তাইদ্রলোককে বৈঠকখানায় না বসিয়ে একেবারে ল্যাবরেটরিতে ডেকে পাঠালাম।

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই নাক সিটকিয়ে বললেন, আপনি কি হিং-এর কারবার ধরেছেন নাকি? পরমুহূর্তেই রোবুর দিকে চোখ পড়তে নিজের চোখ গোল করে বললেন, ওরে বাস্‌- ওটা কী? ওকি রেডিও, না কলের গান না কী মশাই?

অবিনাশবাবু এখনো গ্রামোফোনকে বলেন কলের গান, সিনেমাকে বলেন বায়োস্কোপ, এরোপ্লেনকে বলেন উড়োজাহাজ।

আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ওকেই জিজ্ঞেস করুন না ওটা কী। ওর নাম রোবু

রোবুস্কোপ?

রোবুস্কোপ কেন হতে যাবে? বলছি না ওর নাম রোবু! আপনি ওর নাম ধরে জিজ্ঞেস করুন ওটা কি জিনিস, ও ঠিক জবাব দেবে

অবিনাশবাবু কি জানি বাবা এ আপনার কী খেলা বলে যন্ত্রটার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কী হে, রোবু?

রোবুর মুখের গর্ত থেকে পরিষ্কার স্বরে উত্তর এলো, আমি যান্ত্রিক মানুষ প্রোফেসর শঙ্কুরীর সহকারী

ভদ্রলোকের প্রায় ভিরমি লাগার জোগাড় আর কি। রোবু কী কী করতে পারে শুনে, আর তার কিছু কিছু নমুনা দেখে অবিনাশবাবু একেবারে ফ্যাকাশে মুখ করে আমার হাত দুটো ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। বুঝলাম এবার তিনি সত্যিই ইমপ্রেস



আজ একটা পুরনো জার্মান বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রোফেসর বোর্গেল্টের লেখা রোবো সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ হঠাৎ চোখে পড়ে গেল উনি বেশ দেমাকী মেজাজেই লিখেছেন যে, যান্ত্রিক মানুষ তৈরির ব্যাপারে জার্মানরা যা কৃতিত্ব দেখিয়েছে, তেমন আর কোনো দেশে কেউ দেখায়নি। তিনি আরো লিখেছেন যে, যান্ত্রিক মানুষকে দিয়ে চাকর-বাকরের মতো কাজ করানো সম্ভব হলেও, তাকে দিয়ে কাজের কাজ বা বুদ্ধির কাজ কোনদিনই করানো যাবে না



প্রোফেসর বোর্গেল্টের একটা ছবিও প্রবন্ধটার সঙ্গে রয়েছে প্রশস্ত ললাট, ভূরু দুটো অস্বাভাবিক রকম চওড়া প্রায় চারকোনা কালো দাড়ির চাবড়া।

দ্রলোকের লেখা পড়ে আর তার চেহারা দেখে তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহটা আরো বেড়ে গেল।



২৩শে মে

আজ সকালে হাইডেলবার্গ পৌছেছি। ছবির মতো সুন্দর শহর, ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থিতির জন্য প্রসিদ্ধ নেকার নদী শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে, পেছনে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বনে ঢাকা পাহাড়। এই পাহাড়ের উপর রয়েছে হাইডেলবার্গের এতিহাসিক কেল্লা। শহর থেকে পাঁচ মাইল বাইরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রোফেসর পমারের বাসস্থান। সত্তর বছরের বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক আমাকে যে কী খাতির করলেন তা বলে বোঝান যায় না। বললেন, ভারতবর্ষের প্রতি জার্মানির একটা স্বাভাবিক টান আছে জানো বোধহয়। আমি তোমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্য দর্শন ইত্যাদির অনেক বই পড়েছি। ম্যাক্স মুলার এসব বইয়ের চমৎকার অনুবাদ করেছেন। তার কাছে আমরা বিশেষভাবে ণী। তুমি একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক হয়ে আজ যে কাজ করেছ, তাতে আমাদের দেশেরও গৌরব বাড়ল।



রোবুকে তার সাইজ অনুযায়ী একটা প্যাকিং কেসে খড়, তুলো, করাতের গুঁড়ো ইত্যাদির মধ্যে খুব সাবধানে শুইয়ে নিয়ে এসেছিলাম। পমার তাকে দেখার জন্য খুবই কৌতুহল হচ্ছে জেনে আমি দুপুরের মধ্যেই তাকে বাক্স থেকে বার করে ঝেড়ে পুঁছে পমারের ল্যাবরেটরিতে দাঁড় করলাম। পমার এ জিনিসটি নিয়ে এত গবেষণা এত লেখালেখি করলেও নিজে কোনদিন রোবো তৈরি করেননি।

রোবুর চেহারা দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। বললেন, এ যে তুমি দেখছি আঠা, পেরেক, আর স্টিকিং প্লাস্টার দিয়েই সব জোড়ার কাজ সেরেছ! তুমি বলছ এই রোবু কথা বলে, কাজ করে? পমারের গলায় অবিশ্বাসের সুর অতি স্পষ্ট।

আমি একটু হেসে বললাম, আপনি ওকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ওকে প্রশ্ন করুন না।

পমার রোবুর দিকে ফিরে বললেন, Welche arbeit machst do? (তুমি কী কাজ কর?)

রোবু স্পষ্ট গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে উত্তর দিল, Ich helfe meinem herm beiseiner arbert, und lose mathematische problem (আমি আমার মনিবের কাজে সাহায্য করি, আর অঙ্কের সমস্যার সমাধান করি)।

পমার রোবুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে কিছুক্ষণ মাথা নাড়লেন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, শঙ্কু, তুমি যা করেছ, বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই। বোর্গেল্টের ঈর্শা হবে!

এর আগে বোর্গেল্ট সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। হঠাৎ পমারের মুখে তাঁর নাম শুনে একটু চমকেই গেলাম। বোর্গেল্টও কি নিজে কোনো রোবো তৈরি করেছেন নাকি?



আমি কিছু জিগ্যেস করার আগেই পমার বললেন, বোর্গেল্ট হাইডেলবার্গেই আছে, আমারই মত নির্জন পরিবেশে, তবে নদীর ওপারে। আমার সঙ্গে আগে যথেষ্ট আলাপ ছিল- বন্ধুত্বই বলতে পার। একই স্কুলে পড়েছি বার্লিনে- তবে ওর চেয়ে আমি তিন বছরের সিনিয়র ছিলাম। তারপর আমি হাইডেলবার্গে এসে ডিগ্রী পড়ি। ও বার্লিনেই থেকে যায়। বছর দশেক হলো ও এখানে এসে ওদের পৈত্রিক বাড়িতে রয়েছে।

উনি কি নিজে রোবো তৈরি করেছেন?

অনেকদিন থেকেই লেগে আছে- কিন্তু বোধহয় সফল হয়নি। মাঝে তো শুনেছিলাম ওর মাথাটা একটু বিগড়েই গেছে। গত ছমাস ও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। আমি টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছি কয়েকবার, প্রতিবারই ওর চাকর বলেছে বোর্গেল্ট অসুস্থ। ইদানিং আর ফোন-টোন করিনি।

আমি এসেছি সেটা কি উনি জানেন?

তা তো বলতে পারি না। তুমি আসছ সেকথা এখানকার কয়েকজন বৈজ্ঞানিককে আমি বলেছি-তাদের সঙ্গে তোমার দেখাই হবে। খবরের কাগজের লোকও কেউ কেউ জেনে থাকতে পারে। বোর্গেল্টকে আর আলাদা করে জানানোর প্রয়োজন দেখিনি।

আমি চুপ করে রইলাম। দেয়ালে একটা কুকু ক্লকে কুকু শব্দ করে চারটে বাজল। খোলা জানালার বাইরে বাগান দেখা যাচ্ছে, তারও পিছনে পাহাড়। দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

পমার বলল, রাশিয়ার স্ট্রোগোনাফ, আমেরিকার প্রোফেসর স্টাইনওয়ে, ইংল্যান্ডের ডাঃ ম্যানিংস-এঁরা সকলেই রোবো তৈরি করেছেন। জার্মানিতেও তিন-চারটে রোবো তৈরি হয়েছে- আর সেগুলো সবই আমি দেখেছি। কিন্তু তাদের কোনটাই এত সহজে তৈরি হয়নি, আর এমন স্পষ্ট কথাও বলতে পারে না।

আমি বললাম, ও কিন্তু অঙ্কও করতে পারে। ওকে যে-কোনো অঙ্ক দিয়ে তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পার।

পমার অবাক হয়ে বলল, বল কী! ও আউয়েরবাখের ইকুয়েশন জানে?

জিজ্ঞেস করে দেখ।

রোবুকে পরীক্ষা করে পমার বললেন, এ একেবারে তাজ্জব কাণ্ড। সাবাস তোমার প্রতিভা। তারপর একমুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, তোমার রোবু কি মানুষের মতো অনুভব করতে পারে!

আমি বললাম, না- ও-জিনিসটা ও পারে না।

পমার বলল, আর কিছু না হোক, তোমার ব্রেনের সঙ্গে ওর যদি একটা সংযোগ থাকত তাহলে খুব ভালো হতো। অন্তত তোমার সুখ-দুঃখ যদি ও বুঝতে পারত তাহলে তোমার একজন নির্ভরযোগ্য সাথী হতে পারত।

পমার যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, আমি ওই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি- একটা যান্ত্রিক মানুষকে কী করে একটা রক্ত-মাংসের মানুষের মনের কথা বোঝানো যায়। এ নিয়ে অনেক দূর আমি এগিয়েও ছিলাম, কিন্তু তারপর বুড়ো হয়ে পড়লাম। ব্রেনটা ঠিকই ছিল কিন্তু হৃদরোগ ধরে কাবু করে দিল। আর, যে রোবোর উপর এইসব পরীক্ষা চালাব, সেটা তৈরি করারও আমার সামর্থ্য রইল না

আমি বললাম, আমি রোবুর কাজে দিব্যি খুশি আছি। ও যতটুকু করে তাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।

পমার কিছু বললেন না। তিনি দেখি একদৃষ্টে রোবুর দিকে চেয়ে আছেন। রোবুর মুখে সেই হাসি। ঘরের জানালা দিয়ে পড়ন্ত রোদ ঢুকে রোবুর বা চোখটার উপর পড়েছে। রোদের ঝলকানিতে ইলেকট্রিক বাল্ভের চোখও মনে হয় হাসছে।



২৪শে মে

এখন রাত বারোটা। আমি পমারের বাড়ির দোতলার ঘরে বসে আমার ডায়রি লিখছি। গতকাল মাঝ রাত্তির থেকে আরম্ভ করে আজ সারাদিনের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, সব গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। কতদূর পারব তা জানি না, কারণ আমার মন ভালো নেই। জীবনে আজ প্রথম আমার মনে সন্দেহ জেগেছে যে আমি নিজেকে যত বড় বৈজ্ঞানিক বলে মনে করেছিলাম, সত্যিই আমি তত বড় কিনা। তাই যদি হতাম, তাহলে এভাবে অপদস্ত হলাম কেন?

কাল রাত্রের ঘটনাটাই আগে বলি। এটা তেমন কিছু না, তবু লিখে রাখা ভালো।

রাত্রে পমার আর আমি ডিনার শেষ করে উঠেছি নটায়। তারপর দুজনে বৈঠকখানায় বসে কফি খেতে খেতে অনেক গল্প করেছি। তখনও পমারকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে দেখেছি। কি ভেবেছিল কে জানে। হয়ত রোবুকে দেখা অবধি ওর নিজের অক্ষমতার কথাটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। সত্যিই, ও যে রকম বুড়ো হয়ে গেছে, তাতে ওর পক্ষে আর রোবো নিয়ে নতুন করে কোনো গবেষণা করা সম্ভব বলে মনে হয়না

আমি শুতে গেছি দশটার কিছু পরে। যাবার আগে রোবুকে দেখে গেছি। পমারের ল্যাবরেটরিতে ও দিব্যি আরামে আছে বলেই মনে হলো। জার্মানির আবহাওয়া, এখানকার শীত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-এসবের প্রতি ওর কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। ও যেন শুধু অপেক্ষা করে আছে আমার আদেশের জন্য

ঘুমোতে যাবার আগে আমরা দুই বৈজ্ঞানিক জার্মান ভাষায় ওর কাছে বিদায় নিলাম। রোবুও পরিষ্কার গলায় বলল, গুটে নাখ্ট, হের্‌ প্রোফেসর শঙ্কু-গুটে নাখট হের্‌ প্রোফেসর পমার!

বিছানার পাশের বাতি জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ একটা ম্যাগাজিন উল্টে-পাল্টে ঢংঢং করে নিচের সিঁড়ির গ্রান্ডফাদাঁর ঘড়িতে এগারটা বাজা শুনে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি।

মাঝরাত্তিরে যখন ঘুম ভেঙেছে তখন কটা বেজেছে জানি না। ঘুমটা ভেঙেছে একটা আওয়াজ শুনেই-আর সে আওয়াজটা আসছে আমার ঘরের ঠিক নিচে পমারের ল্যাবরেটরি থেকে। খট খট খট ঠং ঠং-খটখট। একবার মনে হচ্ছে কাঠের মেঝের উপর মানুষের পায়ের আওয়াজ, আরেকবার মনে হচ্ছে যন্ত্রপাতি ঘাটাঘাটির শব্দ।

তবে আওয়াজটা পাচ মিনিটের বেশি আর শুনতে পেলাম না। তাও বেশ কিছুক্ষণ কান খাড়া করে শুয়ে রইলাম- যদি আরো কোনো শব্দ হয়। কিন্তু তারপরে ঘড়িতে তিনটে বাজার শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনিনি।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় পমারকে আর এ বিষয়ে কিছু বললাম না। কারণ আমার ঘুমের কোনরকম ব্যাঘাত হয়েছে শুনে ও হয়তো ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

ব্রেকফাস্টের পর একটু বেড়াতে যাবো বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু টেবিল ছেড়ে ওঠার আগেই পমারের চাকর কুর্ট এসে একটা ভিজিটিং কার্ড তার মনিবের হাতে দিল। নাম পড়ে পমার অবাক হয়ে বলল, সে কি, বোর্গেল্ট এসেছে দেখছি!

আমিও খবরটা জেনে রীতিমত অবাক হলাম।

বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি, গিরিডিতে থাকতে জার্মান পত্রিকার ছবিতে যে মুখ দেখেছিলাম, এ সে-ই মুখ, কেবল চুলে আরো অনেক বেশি পাক ধরেছে। আমরা ঢুকতেই বোর্গেল্ট সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভিবাদন জানালেন। এত বয়স সত্তেও তাঁর চটপটে মিলিটারি ভাব দেখে আশ্চর্য লাগল। এঁরও তো প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়স- কিন্তু কী জোয়ান স্বাস্থ্য!

পমার বললেন, কই বোর্গেল্ট, তোমাকে দেখে তো লম্বা অসুখ থেকে উঠেছ বলেও মোটেই মনে হয় না- বরং মনে হচ্ছে চেঞ্জে গিয়ে শরীর সারিয়ে এসেছ।

বোর্গেল্ট ভারী গলায় হো হো করে হেসে বলল, অসুখ বললে লোকে উৎপাতটা কম করে, ব্যস্ত আছি বললে অনেক সময়ই কাজ হয় না- বরং লোকের তাতে কৌতুহলটা বেড়েই যায়, আর তখন তারা টেলিফোন করে বার বার জানতে চায়, ব্যস্ততার কারণ কী। বুঝতেই পারছ সে-কারণটা সব সময় বলা যায়না?

তা অবিশ্যি যায় না

পমার বোর্গেল্টকে পানীয় অফার করতে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, ও জিনিসটা একদম ছেড়ে দিয়েছি, আর আমার সময়ও খুব বেশি নেই। আমি আজকের খবরের কাগজে রোবো-সহ প্রোফেসর শঙ্কুর এখানে আসার কথা পড়লাম। ও ব্যাপারে আমার কি রকম কৌতুহল সে তো জানোই। তাই খবর না দিয়েই একেবারে সটান চলে এলাম। আশা করি কিছু মনে করনি।

না,না।

আমি বললাম, আপনি বোধহয় তাহলে আমার যন্ত্রটি একবার দেখতে চান।

সেই জন্যেই তো আসা। আপনি কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন সেটা জানার স্বভাবতই একটা আগ্রহ হচ্ছে।

বোর্গেল্টকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এলাম।

রোবুকে দেখেই বোর্গেল্টের প্রথম কথা হলো, আপনি বোধহয় চেহারাটার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেননি। আমার মনে হয় এ জিনিসটাকে যান্ত্রিক মানুষ না বলে কেবল যন্ত্র বলাই ভালো- তাই নয় কি?

এটা অবিশ্যি আমি অস্বীকার করতে পারলাম না। বললাম, আমি কাজের উপরই জোরটা দিয়েছি বেশি- সেটা ঠিক।

তোমার রোবো ভালো অঙ্ক কষতে পারে শুনেছি

টেস্ট করবেন?

উত্তরটা রোবুর মুখ থেকে এত জোরে এল যে পমারের ল্যাবরেটরির কাচের জিনিসপত্র সব ঝনঝন করে উঠল। এত জোরে রোবু কখনো কথা বলে না। স্পষ্ট বুঝলাম- আর বুঝে অবাক হলাম যে, বোর্গেল্টের প্রশ্নে রোবু বিরক্ত হয়েছে।
১ম পর্ব শেষ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন