রবিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২২

পাউলির বর্জননীতি, পাউলি ইফেক্ট ও ওলফগ্যাংগ পাউলির জীবনী - Wolfgang Pauli, exclusion principle and Pauli effect

পাউলির বর্জননীতি, পাউলি ইফেক্ট ও ওলফগ্যাংগ পাউলি - Wolfgang Pauli, Exclusion principle and Pauli effect - ওলফগ্যাংগ পাউলির জীবনী
পাউলির বর্জননীতি, পাউলি ইফেক্ট ও ওলফগ্যাংগ পাউলি - Wolfgang Pauli, Exclusion principle and Pauli effect - ওলফগ্যাংগ পাউলির জীবনী

পাউলির বর্জননীতি, পাউলি ইফেক্ট ওলফগ্যাংগ পাউলির জীবনী - Wolfgang Pauli, Exclusion principle and Pauli effect

পাউলির জন্ম ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা শহরে। আঠারো বছর বয়সে হাইস্কুল শেষ করার তিন মাস পরেই পাউলি সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এক বছর পরে একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্বের ওপর লেখা তাঁর প্রবন্ধ পড়ার পর হেরমান ভাইল তাকে এই নতুন বিষয়ে সহকর্মী হিসেবে সাদর আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি এনসাইক্লোপিডিয়ার জন্য যে প্রবন্ধ লেখেন তাকে স্বয়ং আইনস্টাইন আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘পরিণত এবং বিশালভাবে পরিকল্পিত।এই হলো পাউলির শুরু।

শতাব্দীর সবচেয়ে নামকরা পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন হলেন ওলফগ্যাংগ পাউলি (Wolfgang Ernst Pauli) ১৯৪৫ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখে গিয়েছেন। তার কাজের মধ্যে রয়েছে গভীর ভৌত অন্তদৃষ্টি এবং বিশাল গাণিতিক দক্ষতা। কিন্তু যে জন্য পাউলি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন, তা হলো তাঁর নির্দয় সমালোচনা। চিন্তাধারার মধ্যে অস্পষ্টতা তিনি মোটেই সহ্য করতেন না। জন্য সকলেই তাঁকে প্রচণ্ড ভয়ও করতেন। অনেকেই তাকে পদার্থবিজ্ঞানের বিবেক বলেও মনে করতেন।

১৯২১ সালের গ্রীষ্মকালে পাউলি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্নল্ড সমারফেল্ডের (Arnold Johannes Wilhelm Sommerfeld) অধীনে তার পিএইচ. ডি.- কাজ শেষ করেন। সময়ে তাঁর বন্ধু ছিলেন ভার্নার হাইজেনবার্গ (Werner Karl Heisenberg) দুজনের বন্ধুত্ব সারাজীবন অক্ষুন্ন ছিল। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল হাইড্রোজেন অণুর আয়ন। প্রচলিত বোর নকশা ব্যবহার করার অসুবিধা তিনি তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে তুলে ধরেন। হাইসেনবার্গের মতোই পাউলিও পরমাণুবিজ্ঞানের তখনকার অবস্থা দেখে মোটেই খুশি ছিলেন না। দুজনই তখন নতুন পথ খুঁজে ফিরেছেন। 

সময়ে কিছুদিন তিনি ম্যাক্স বর্নের (Max Born) সঙ্গে জটিল বস্তু নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু তাঁর ভয় হয়ে গেল যে, গটিনজেনে বর্নের সঙ্গে থাকলে তিনি গণিতবিদ হয়ে উঠবেন, পদার্থবিজ্ঞানী হওয়া আর সম্ভব হবে না। সুতরাং প্রথমে তিনি হামবুর্গ চলে গেলেন ভিলহেলম্ লেনৎস-এর (Wilhelm Lenz) সঙ্গে কাজ করতে এবং তারপর ১৯২২ সালের শরৎকালে নীলস্ বোরের (Niels Henrik David Bohr) আমন্ত্রণে তিনি কোপেনহেগেনে চলে আসেন। নীলস বোর সময়ে পরমাণু গঠনের ওপর তার দীর্ঘ প্রবন্ধের জার্মান সংস্করণ তৈরি করার কাজ করছিলেন। জন্য তার পাউলির সাহায্য প্রয়োজন হয়। আসলে পাউলিকে কোপেনহেগেনে নিয়ে আসার এটা ছিল একটা ছুতো। পাউলিকে দরকার হয়ে পড়েছিল পরমাণু তত্ত্বের কতকগুলো দুরূহ সমস্যা সমাধানের জন্য। ধরনের এক সমস্যা হলোবিষমজীমান প্রক্রিয়া (Zeeman effect) 

চৌম্বকক্ষেত্রে পরমাণু রাখা হলে দেখা যায় যে, বর্ণালি-রেখা তিনটি রেখায় বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। এটাকে বলে সাধারণ বা নর্মাল জীমান প্রক্রিয়া। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, বর্ণালি রেখা চৌম্বক ক্ষেত্রে তিনটির বেশি রেখাতেও বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। এটাকে বলে বিষম বা অ্যানোম্যালাস জীমান প্রক্রিয়া।  [Difference Between Normal and Anomalous Zeeman Effect]

১৯২৪ সালের শেষের দিকেই পাউলি এবং হাইসেনবার্গের দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে, বোরের পরমাণুতত্ত্ব দিয়ে এই বিষম জীমান প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এমনকি অর্ধপূর্ণ সংখ্যার কোয়ান্টাম সংখ্যা নিলেও নয়। প্রয়োজন হলো নতুন ভৌত নীতির। নতুন বলবিজ্ঞানের। পাউলি এসময়কার কথা মনে করে অনেকদিন পরে লিখেছিলেন, কোপেনহেগেনের সুন্দর রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে আমাকে ঘুরতে দেখে এক সহকর্মী বন্ধুর মতো বললেন, “তোমাকে খুব অসুখী দেখাচ্ছে।

আমি রাগ করে বললাম, বিষম জীমান প্রক্রিয়া নিয়ে যে চিন্তা করছে সে কী করে খুশির ভাব দেখাবে।

কে জানত এর দুবছরের মধ্যেই তিনি বর্জন নীতি আবিষ্কার করবেন, যার জন্য তার নাম পদার্থবিজ্ঞানের অংশ হয়ে যাবে।

১৯২৫ সালের বসন্তকালে হাইজেনবার্গ অসুস্থ হয়ে হেগোল্যান্ড দ্বীপে গেলেন এবং সেখানেই তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের সৃষ্টি করলেন। হাইজেনবার্গ যে নতুন গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করলেন তা হলো কারকের অবিনিময়ী গুণন (Heisenberg group) কোপেনহেগেন ফেরার পথে হাইজেনবার্গ পাউলিকে তাঁর নতুন পদ্ধতিটি দেখালেন। পাউলির সমালোচনাকে তিনি এর মধ্যেই যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে শিখেছেন। পাউলি উৎসাহের সঙ্গে হাইসেনবার্গের এই নতুন পদ্ধতিকে সমর্থন করলেন। ১৯২৫ সালের জুলাই হাইজেনবার্গ পাউলিকে তাঁর প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দিলেন, যা পড়ে পাউলি লিখলেন, “এটা হলো ঊষার রক্তিম আভা। 

এভাবেই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের যাত্রা হলো শুরু।

১৯২৫ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ম্যাক্স বর্ন, ভার্নার হাইজেনবার্গ এবং প্যাসকুয়াল জর্ডান নতুন অবিনিময়ী বীজগণিতের মূল কথাগুলো ব্যবহার করে মেট্রিক্স বলবিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ফেললেন। পাউলির হয়তো এসময়ে দুঃখ হয়েছিল যে, এই নতুন খেলায় তার কোনো অংশ ছিল না। তিনি শুধু এই উন্নতির একজন দর্শক মাত্র। কিন্তু শুধু দর্শক হিসেবে থাকা যায় না, তাই পাউলি নিজেকে এই খেলার একজন রেফারি নিয়োগ করলেন। নতুন গণিতসর্বস্ব পদ্ধতিতে কঠোর সমালোচনা করে পাউলি হাইজেনবার্গকে চিঠি লিখতেন। হাইজেনবার্গ এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে লিখলেন, “কোপেনহেগেন এবং গটিনজেনকে তুমি যেভাবে অনন্তকাল ধরে সমালোচনা করো তা একটা লজ্জার ব্যাপার। অন্তত এটুকু তোমার স্বীকার করা উচিত যে, কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা পদার্থবিজ্ঞান নষ্ট করতে বসিনি। যখন তুমি আমাদের গালাগাল দাও যে, আমরা সব বড় বড় গাধা, যারা পদার্থবিজ্ঞানে নতুন কিছু করিনি, তখন হয়তো তুমি ঠিক কথাই বলো। কিন্তু তুমিও তাহলে একইভাবে একটা বৃহৎ গাধা, কেননা তুমিও নতুন কিছু করোনি।

বোধ হয় হাইসেনবার্গের এই আক্রমণ পাউলির মর্মমূলে আঘাত করে। তিনি তাই হাইড্রোজেন পরমাণুর সমস্যাটি হাতে তুলে নিলেন এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন বীজগণিত ব্যবহার করে তার সঠিক সমাধান করে দিলেন। যে গণিতের বিরুদ্ধে তিনি এতদিন সোচ্চার ছিলেন সেই গণিতের সুন্দর ব্যবহার তিনিই দেখালেন। এই প্রবন্ধেই পাউলি লেন্ৎস সদিকরাশি ব্যবহার করে হাইড্রোজেন পরমাণুর বামার-বর্ণালি নির্ধারণ করেন। বোরতত্ত্বের নিষিদ্ধ কক্ষপথ যে কী জিনিস তা এখন খুব সহজভাবেই বোঝা গেল। ঠিক দু'বছর আগে পাউলি হাইড্রোজেন পরমাণুর বোরতত্ত্ব নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এভাবেই পূর্ণচক্রে একবার সম্পূর্ণ ঘুরে আসা হলো।

কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের ভৌত তাৎপর্য এত সহজে পাওয়া যায়নি। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে হাইজেনবার্গ তাঁর বিখ্যাত অনির্দেশ্যতার তত্ত্ব (Heisenberg’s Uncertainty Principle) উপস্থাপন করলেন। পাউলিকে তিনি লিখলেন যে, তিনি যেন তার কঠিনতম সমালোচনা করেন। কিন্তু পাউলি হাইসেনবার্গের কাজকে সমর্থনই দিলেন। কেননা, তাঁর মতে, হাইসেনবার্গের এই ব্যাখ্যা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানকে একটা সুসংহত ভৌত তাৎপর্য দেয়। কিন্তু এই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার ঘোরতর বিরোধী হয়ে দেখা দিলেন স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তিনি আজীবন সম্ভাবনাভিত্তিক এই ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছেন। এই সংঘর্ষে বোর, হাইজেনবার্গ এবং পাউলির দলেরই বিজয় হয়েছে বলে সকলে মনে করেন। কিন্তু ব্যাপারে শেষ কথাটি এখনও উচ্চারিত হয়েছে বলে মনে হয় না।

পাউলি নিজে যে জন্য বিখ্যাত তা অবশ্য তাঁর বর্জননীতি এবং স্পিন পরিসংখ্যানের সম্পর্কের প্রমাণ। ১৯২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি তাঁর বর্জননীতি প্রকাশ করেন। পাউলি বিষম জীমান প্রক্রিয়া সম্বন্ধে চিন্তা করার সময়েই এই নীতি আবিষ্কার করেছিলেন। জীমান প্রক্রিয়ায় পরমাণুর শক্তি স্তরের সমীকরণে একটি উৎপাদক ব্যবহার করতে হয়, যাকে বলে g-উৎপাদক বা ল্যান্ড উৎপাদক (Landé g-factor)। কেননা ল্যান্ড (Alfred Landé) এটি আবিষ্কার করেছিলেন। ল্যান্ড এই উৎপাদকের একটি সমীকরণ পেয়েছিলেন, যার একটি অংশে ছিলসংযোজনীইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ এবং অন্য আর একটি অংশ ছিল, যাকে তিনি মনে করতেনঅভ্যন্তরের ইলেকট্রনের অবদান অর্থাৎ পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশের ঘূর্ণমান ইলেট্রনগুলোকে দুভাগে ভাগ করে বাইরের ইলেকট্রনগুলোকে সংযোজনী বা ভ্যালেন্স ইলেকট্রন এবং ভিতরের ইলেকট্রনগুলোকে অভ্যন্তরের বা কোর ইলেকট্রন বলা হতো। 

১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পাউলি প্রমাণ করেন যে, g-উৎপাদকের অভ্যন্তরীণ ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের ধারণা অর্থহীন। তিনি দেখালেন যে, g-উৎপাদকের মধ্যে শুধু সংযোজনী ইলেকট্রনের ভরবেগই থাকতে পারে। তার ভাষায়, “এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষম জীমান প্রক্রিয়া সংযোজনী ইলেকট্রনের একটা নতুন দ্বৈতমানের জন্যই ঘটে থাকে।

এর আগে স্টোনার প্রথমে প্রস্তাব করেছিলেন যে, পরমাণুর প্রত্যেকটির পরিপূর্ণ খোলসে ইলেকট্রনের সংখ্যা অভ্যন্তরীণ কোয়ান্টাম সংখ্যার যোগফলের দ্বিগুণ। এখানেঅভ্যন্তরীণ কোয়ান্টাম সংখ্যা হলো প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা, কক্ষপথের কৌণিক ভরবেগের (Angular Momentum) কোয়ান্টাম সংখ্যা এবং তার অভিক্ষেপ কোয়ান্টাম সংখ্যা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দ্বিগুণ কেন? এখানেই আসে পাউলির বর্জননীতি (Pauli exclusion principle) পাউলি প্রস্তাব করেন যে, সব পরমাণুর ক্ষেত্রেই এই দ্বৈতমানের ব্যাপারটা প্রাথমিক অনুমান হিসেবেই নেয়া যায়। মনে রাখতে হবে যে, তখনও ইলেকট্রনের ঘূর্ণন বা স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং প্রস্তাব হলো এই যে, ওপরের তিনটি কেয়ান্টাম সংখ্যা ছাড়াও আর একটি কোয়ান্টাম সংখ্যা প্রবর্তন করা প্রয়োজন যার মান শুধু দুটি। অর্থাৎ ইলেকট্রনের অভ্যন্তরীণ কোয়ান্টাম সংখ্যা আসলে চারটি। এখন পাউলির বর্জননীতি এভাবে বলা যায়, “পরমাণুর দুটি বা তার বেশি সমতুল্য ইলেকট্রন থাকতে পারে না, যার কোয়ান্টাম সংখ্যাগুলোর মান একই। 

তিনি লিখেছিলেন, “এই নীতির সঠিক কারণ দেয়া সম্ভব নয়। সঠিক কারণটি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান আবিষ্কারের পরেই পরিষ্কার হয়েছে ডিরাকের (Paul Adrien Maurice Dirac) একটি কাজে। আসলে ইলেকট্রনের স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা হলো / এবং তা একটি ফার্মি বস্তুকণা। সুতরাং ইলেকট্রনের তরঙ্গ-অপেক্ষক বিপরীত প্রতিসাম্যের এবং জন্যই দু'টি ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম সংখ্যা একই মানের হতে পারে না। স্পিন এবং পরিসংখ্যানের সঙ্গে এই নিবিড় সম্পর্ক ১৯৪০ সালে একটি প্রবন্ধে পাউলি প্রমাণ করেন -----যার ফলে এখন আমরা জানি যে, পূর্ণ সংখ্যা স্পিনের বস্তুকণা বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে এবং অর্ধপূর্ণ সংখ্যার স্পিনের বস্তুকণা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। 

১৯২৭ সালের মে মাসে পাউলি ইলেকট্রনের জন্য একটি সমীকরণও লিখেছিলেন, যা ঠিক আপেক্ষিক তত্ত্বসম্মত ছিল না। এখানেই তিনি তিনটি মেট্রিক্স-রাশির প্রবর্তন করেন, যাকে পাউলি মেট্রিক বলে। তিনি জানতেন যে, তার এই কাজসাময়িক এবং আসন্ন মানেরপরে ডিরাক ইলেকট্রনের আপেক্ষিক তত্ত্বসম্মত সমীকরণটি আবিষ্কার করেন।

কিন্তু পাউলির সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজ বোধ হয় নিউট্রিনো বস্তুকণার ভবিষ্যদ্বাণী! নিউট্রিনো এমন একটি বস্তুকণা, যার ভর নেই, আধান নেই কিন্তু আছে শুধু স্পিন বা নিজস্ব ঘূর্ণন, যার মান / ! পাউলি নিউট্রিনোকে বলেছেন, “তাঁর জীবনের সংকট-মুহূর্তের (১৯৩০-৩১) বোকা সন্তান, যা পরে আরো বোকার মতো আচরণ করেছে।

আসলে ব্যক্তিগত জীবনে এই সময়ে তার প্রথম অসুখী বিবাহ ভেঙে যায়। নিউট্রিনো আবিষ্কারের ঘটনা তিনি এভাবে লিখেছেন, “বোকা সন্তানটির ইতিহাস শুরু হয় অবিচ্ছিন্ন বিটা বর্ণালি সম্বন্ধে উত্তপ্ত আলোচনা থেকে, যা সে সময়ে মাইটনার (Lise Meitner) এবং এলিসের মধ্যে চলছিলসেটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

নিউক্লিয়াস থেকে বিটা বা ইলেকট্রন কণা নির্গত হওয়ার সময়ে দেখা যায় যে, ইলেকট্রনের শক্তি অবিচ্ছিন্ন প্রকৃতির। শক্তি এবং ভরবেগের সংরক্ষণ নীতির এটা পরিপন্থী এবং নীলস্ বোরের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীও এক সময়ে ধারণা করেছিলেন যে, হয়তো শক্তি সংরক্ষণের নীতি বজায় রাখা যাবে না। কথা সত্যি হলে একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হতো বলাই বাহুল্য। তাই ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর টুবিনগেনে বিজ্ঞানীদের তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে করা এক সভার উদ্দেশ্যে পাউলি লেখেন, “প্রিয় তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, আমি একটা দুঃসাহসিক পথ বাতলাতে পারি--সম্ভাবনাটা হলো এই যে, নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে আধানহীন একটা বস্তুকণা থাকতে পারে, যার ঘূর্ণন হলো /! অবিচ্ছিন্ন বিটা-বর্ণালি তাহলে বোঝা যাবে এই অনুমান থেকে যে, বিটাভাঙ্গন প্রক্রিয়ায় একটি নিউট্রিনো ইলেকট্রনের সঙ্গে নির্গত হয় এমনভাবে যে, নিউট্রিনো এবং ইলেকট্রনের শক্তির যোগফল ধ্রুব,হয়।

এভাবে পাউলি শক্তি সংরক্ষণের নীতি বজায় রাখার সহজ পথ দেখিয়ে দিলেন, যা বহু বছরে ধরে পরীক্ষণের মাধ্যমে সুপ্রমাণিত হয়েছে। এই নিউট্রিনো বস্তুকণার আরো অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয়েছে। তার ঘূর্ণন সবসময়ে বাঁ-হাতি এবং এন্ট্রি-নিউট্রিনের ঘূর্ণন সবসময় ডানহাতি। এটাই প্রথমে সালাম (Mohammad Abdus Salam) আবিষ্কার করেন, যা পাউলি প্রথম দিকে স্বীকার করতে চাননি। আজ অবশ্য নিউট্রিনোর এইসব বিচিত্র গুণ একত্রিত করে সালাম-ভাইনবার্গ গ্লাসহাউ তত্ত্ব (Glashow-Weinberg-Salam theory of electroweak interactions and the neutral currents) সৃষ্টি করা হয়েছে, যাকে এখন প্রমাণ তত্ত্ব বলা হয়। 

পাউলি নিজের সম্বন্ধে বলেছেন, “আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন বিশ্বাস করতাম যে, আমি একজন বিপ্লবীআসলে আমি সনাতন পন্থী, বিপ্লবী নই।

কথা বলার সময়ে তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ সামান্য এপাশ-ওপাশে নড়াচড়া করত। জীবনের শেষের দিকে (মৃত্যু ১৯৫৮) তার দুঃখ ছিল যে, গবেষণা করার মতো কিছুই তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার কারণ তাঁর ভাষায়, “বোধহয় আমি খুব বেশি জানি। 

ইশ ভাইস মেহর, আমি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জানি।এটা আসলেই সত্য ভাষণ, অন্তত ওলফগ্যাংগ পাউলির ক্ষেত্রে।

 Tags: পাউলির বর্জননীতি, পাউলি ইফেক্ট ও ওলফগ্যাংগ পাউলি, Wolfgang Pauli, Pauli exclusion principle bangla, Pauli effect bangla, ওলফগ্যাংগ পাউলির জীবনী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন