![]() |
কুড়েৱ বাদশা (নিউটনের গতি ও সরণের তিনটি সুত্র এবং পদার্থ ) Newton's Law of Motion by story (Bangla) |
পূর্বের পর্ব - পদার্থের ধ্বংস নেই
কুড়েৱ বাদশা (পদার্থ এবং নিউটনের গতি ও সরণের তিনটি সুত্র)
এ-হেন
যে পদার্থ, এদের হালচাল সম্বন্ধে নিউটন তিনটে নিয়ম আবিষ্কার করেছেন।
তার মধ্যে প্রথম নিয়মটার মূল কথা হলো, পদার্থরা সবাই
সাংঘাতিক কুঁড়ে! বাইরে থেকে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ (force) না
করলে তারা নড়াচড়া করতে একেবারেই নারাজ। আর বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ করে তাদের যদি একবার
নড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে যে-দিকে আর যতো জোরে তাদের নড়িয়ে দেবে তারা সেই দিকে
আর তেমনি জোরেই চিরকাল নড়ে চলতে থাকবে। পদার্থরা যে আপনি-আপনি নড়াচড়া করে না তা
তো অষ্টপ্রহর দেখতেই পাচ্ছো : টেবিলের ওপর কলমটা পড়ে রয়েছে—ঝড়ের
ধাক্কায় গড়িয়ে যায়, হাত দিয়ে ঠেললে যায় সরে; কিন্তু আপনি-আপনি নিজের থেকে নড়াচড়া করবার কোনো নাম নেই। কিন্তু নিউটনের
ওই নিয়মটার বাকী কথাটুকু বুঝতে যেন খটকা লাগে। বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ করে কোনো
পদার্থকে একবার একভাবে নড়িয়ে দিলে সেটা চিরকাল একই ভাবে একই দিকে নড়ে চলে
কোথায়? তা যদি সত্যি হত তাহলে তো আর কোনো ভাবনাই থাকতো না।
আমরা পাঁচজনে একটা মোড়ার ওপর চেপে বসতাম, তুমি এক ধাক্কায়
সেটাকে সামনের দিকে ঠেলে দিতে আর সেটা চিরকালই সোজা এগিয়ে চলতো আর আমরা পায়ের
ওপর পা তুলে দিয়ে তেপান্তরের মাঠ। পেরিয়ে কোথায় চলে যেতাম। কিন্তু তা তো আর
সত্যিই হয় না। একটুখানি ঘষড়ে নড়ে মোড়াটা থেমে যায় যে।
তাহলে, নিউটনের
ওই নিয়মটা সত্যি হলো কী করে?
নিউটন
কিন্তু বলেছেন—তা হোক, তবু আমার নিয়মটার ভুল নেই। ওটা যে শেষ
পর্যন্ত থেমে যায় তার আসল কারণ হলো একবার একদিক থেকে বলপ্রয়োগ করে ওটাকে চালু করে
দেবার পর ওটার ওপর উলটো দিক থেকে উলটো রকম বলপ্রয়োগ হয় আর এই দোটনায় পড়ে ওটা
যায় থেমে। ঠেলা খেয়ে মোড়াটা যখন এগুচ্ছে তখন তো মাটির সঙ্গে ঘষা লাগছে, আর এই ঘষা লাগবার দরুন যে শক্তি সেই শক্তিই ওটার গতিকে বাধা দিতে দিতে শেষ
পর্যন্ত থামিয়ে দিচ্ছে। ঘষা যততা কমে ততই কমে যায় ঘষা লাগবার শক্তি। তাই মসৃণ
কিছুর ওপর এক ধাক্কায় একটা জিনিস কতোদূর চলে যায়! পরীক্ষা করে দেখতে চাও?
পেছলা যায়গায় পা-পিছলে আলুর দম হয়ে দেখো না, কতদূর চলে যাবে।
ক্যারম
খেলবার সময় মাঝে মাঝে ক্যারমের ওপর ফ্রেঞ্চ চক মাখিয়ে দেওয়া হয়। তার আসল
উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছে তো? তাতে ক্যারমের শরীরটা মসৃণ হবে, ঘষা লাগবে কম, ঘুটিকে একটু ঠোকর দিলেই অনেক সহজে আরো
অনেক বেশিক্ষণ ধরে সেটা নড়াচড়া করতে পারবে ! দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর বুকের উপর কোনো জিনিসকেই এমন মসৃণ করা যায় না যে ঘষার শক্তি
একেবারে দূর হবে আর সেই সঙ্গে দূর হবে উলটো দিক থেকে বলপ্রয়োগের ব্যাপার। তা যদি
সম্ভব হত তাহলে একটা জিনিসকে একবার ঠেলা দিলেই সেটা চিরকাল সোজা এগিয়ে চলত।
একটুকরো
দড়িতে একটা ঢিল বেঁধে মাথার ওপর ঘোরাও, দেখবে হাতে বেশ জোর লাগে।
কেন বলে দেখি?
দড়িটা
সমানভাবে ঘোরালে তার গতির বেগ বদলায় না বটে, কিন্তু গতির দিক বদলায়।
হাতে যে-জোরটা লাগে তা প্রতি মূহুর্তে এই দিক বদল করানোর জন্যেই। হাত জোর দেওয়া
বন্ধ করো, দড়িটা ছেড়ে দাও—দেখবে সঁ
করে ঢিলবাঁধা দড়িটা এক দিকে ছিটকে যাবে। তার মানে, প্রতি মুহূর্তেই
ঢিলটা ওই রকম একদিক না একদিকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চায়। তুমি জোর করে ওটাকে সেই
মুখ থেকে সরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে আর তার জন্যেই তোমার হাতের জোর লাগছে। ঘোরাতে
ঘোরাতে দড়িটা হটাৎ ছেড়ে দাও, দেখবে ঢিলটা ছিটকে বেরিয়ে গেলো।
এই
রকম গোল রাস্তায় ঘোরবার সময় সব জিনিসেরই চেষ্টা ওই ঢিলটার মত—কেন্দ্র
থেকে দূরে চলে যাবার। নেহাত ঢিলটার মতো টিকি বাঁধা থাকলে তারা গোল রাস্তায় ঘোরে, তা
না হলেই পগার পার।
পৃথিবী
তো সূর্যের চারদিকে ঘুরছে এই রকমই গোল রাস্তায়। কই ঢিলটার মতো পগার পার তো হয়
না! কে ওর টিকি বেঁধে রেখেছে?
রেখেছেই
তো। সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিটা! পৃথিবী প্রতি মুহূর্তেই চাইছে ওই ঢিলটার মত
সূর্য থেকে ছিটকে পালাতে, সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি চাইছে। পৃথিবীটাকে
হিড়হিড় করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসতে। এই দুরকম চেষ্টার ফলেই পৃথিবী সূর্যের
চারপাশে গোল রাস্তায় ঘোরে। আজ যদি পৃথিবীর ঘোরার গতি বন্ধ হয় তাহলে আর সূর্যের
মাধ্যাকর্ষণকে কেউ সামলাতে পারবে না— পৃথিবী গিয়ে পড়বে
সূর্যের ঘাড়ের ওপর। কিংবা যদি কেউ পৃথিবীটাকে সূর্যের কাছ থেকে এক ইঞ্চি দূরে
সরিয়ে দেয় তাহলে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের জোর একটু কমে যাবে। তখন আর সে পৃথিবীটাকে
সামলাতে পারবে না। পৃথিবীও ছিটকে চলে যাবে ওই ঢিলটার মতো।
মোটের
ওপর মোড়াটাকে তুমি যখন ঠেলে দিলে তখন সেটা ঘষা খেয়ে থেমে গিয়েছিলো। কিন্তু
পৃথিবী ঘোরার রাস্তায় কিছু নেই, তাই কিছুর সঙ্গেই ঘষা খাবার কথা ওঠে না, আর তাই পৃথিবীটা সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ওই মোড়াটার মতন অমন
থেমে যায় না।
মোড়র
মতো অতোটা ঘষা না খেলেও গাড়ির চাকা গড়াবার সময় কিছু ঘর্ষণ পায়; তা
না হলে একবার ঠেলে দিলেই গাড়িটা চিরকাল চলতে থাকত।
নিউটনের
দ্বিতীয় নিয়ম। পদার্থরা কী ভীষণ কুঁড়ে তা তো দেখতেই পেলে। তাদের দিয়ে কাজ করানোর
দাওয়াই হলো প্রহার। অর্থাৎ কি না বলপ্রয়োগ করলেই কুঁড়ে পদার্থদের দিয়ে কাজ
আদায় করা যায়। আর, যেদিকে বলপ্রয়োগ করবে সেই দিকেই তারা ছুটবে
আর যত জোরে বলপ্রয়োগ করবে ছুটবেও ততত জোরে। ক্রিকেটের বলে ঠিকমতো ব্যাট চালাতে না
পারলে কি আর বাউণ্ডারি হয়?
আর, পারো
যদি তেমন জোরে ব্যাট চালাতে তাহলে একেবারে ওভার বাউণ্ডারি।
এই
হলো নিউটনের দ্বিতীয় নিয়মঃ পদার্থর ওপর বলপ্রয়োগ করলে যেদিকে বলপ্রয়োগ হয়
পদার্থরা নড়ে সেই দিকে আর বলপ্রয়োগ যতো জোর হবে পদার্থর গতি ততোই বাড়বে। অবশ্য, কথাটা
খুব খুটিয়ে বলা হলো না;
কেননা, খুঁটিয়ে
বলতে গেলে শুরু করতে হবে আঁক কষা। পদার্থের গতি সম্বন্ধে নিউটন আরো একটা নিয়ম
আবিষ্কার করেছিলেন। সেটা কিন্তু বড়ো খটোমটো। তাই ওই তৃতীয় নিয়মটার কথা বাদ
দিয়ে বরং চলো দেখা যাক, পদার্থ কতো রকমের।
মূল লেখকঃ দেবীদাস মজুমদার
লেখার সময় কালঃ ১৯৬০ সাল
নতুন আঙ্গিকে লেখা, সম্পাদনা, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনঃ মারুফ মাহমুদ, ঢাকা কলেজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন