রবিবার, ৬ জুন, ২০২১

গল্পে গল্পে তাপগতিবিদ্যাঃ পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণ - Conduction, Convection, and Radiation

আগের পর্ব - প্রচণ্ড শীতেও সমুদ্রের মাছ জমে যায় না কেন?

 

গল্পে গল্পে তাপগতিবিদ্যা, পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণ, তাপগতিবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ,Conduction, Convection, and Radiation

গল্পে গল্পে তাপগতিবিদ্যাঃ পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণ - Conduction, Convection, and Radiation

যদি একটা লোহার লাঠির একটা দিক আগুনের ভেতর ভরে দাও তাহলে খানিক পরেই তার অন্য দিকটাও এমন গরম হয়ে উঠবে যে তাকে আর হাতে ধরে রাখা সম্ভব হবে না কিন্তু একটা কাঁচের লাঠি কিংবা কাঠের লাঠির বেলায় অন্যরকম : কাঠের লাঠিটার একপ্রান্তে আগুন ধরে যাবার পরও তার অন্য প্রান্তটা অনায়াসে খালি হাতে ধরে রাখতে পারি

বৈজ্ঞানিকদের ভাষায় এই ব্যাপারটার কী রকম বর্ণনা হবে জানো? তারা বলবেন, লোহার পক্ষে তাপ পরিবহনের (conduction) ক্ষমতা বেশি, কাঁচ বা কাঠের পক্ষে কম পরিবহন মানে বুঝলে তো? এখন নিজেই পরীক্ষা করে দেখবে সমস্ত ধাতুর বেলাতেই তাপ পরিবহনের ক্ষমতা সমার নয় কারো বেশি, কারো কম ধাতুদের মধ্যে এই ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ওস্তাদ হলো রূপা আর পরীক্ষা যদি করতে পারো তাহলে দেখবে, ঘন পদার্থদের তুলনায় তরল পদার্থ আর গ্যাসদের এই শক্তি খুবই কম  

তাপ পরিবহন বলে ব্যাপারটা আরো ভালো করে বুঝবার চেষ্টা করা যাক শীতকালের ভোর বেলায় তুমি ময়দানে বেড়াতে গেছ, সেখানে একটা লোহার বেঞ্চি দেখে তুমি তার ওপর বসতে গেলে, কিন্তু বেঞ্চিটায় হাত দিতেই হাতটা ঠাণ্ডায় যেন কেঁপে উঠলো ধরো, তার পাশেই একটা কাঠের টুকরো পড়েতাতে হাত দিতে কোন অস্বস্তি হয় না! অথচ লোহা আর কাঠ দুইই তো সারা রাত ধরে একই ঠাণ্ডায় পড়ে আছে গ্রীষ্মকালের দুপুর বেলাতেও তাই : সরাদিন ধরে এক টুকরো লোহা আর এক টুকরো কাঠ রোদে ফেলে রাখো আর তারপর দুটোর ওপর দুহাত দিয়ে দেখো-দেখবে লোহার টুকরোটা গরম হয়ে প্রায় আগুন হয়ে আছে, কাঠের টুকরোটা নিশ্চয়ই তা নয় কিন্তু কথা হলো, এই তফাতটা হয় কেন?

উত্তরে ওই একই কথা : কাঠের চেয়ে লোহা তাপের ভালো পরিবাহক আর তাই শীতকালের ভোর বেলায় ঠাণ্ডা লোহাটা তোমার হাত থেকে খুব তাড়াতাড়ি তাপ সরিয়ে নেয় আর গরমকালে তেতে ওঠা লোহাটা তোমার হাতে খুব তাড়াতাড়ি তাপ পাঠিয়ে দেয় আগেই বলেছি, ঘন পদার্থের তুলনায় তরল পদার্থের তাপ পরিবহনের ক্ষমতা খুব কম কিন্তু বিশেষ বিশেষ অবস্থায় তরল পদার্থরা ঘন পদার্থের চেয়েও ভালো করে তাপ নিয়ে যেতে পারে ছবিটা দেখো

বাঁ দিকের ছবিতে দেখে : পানিটা ফুটবার আগেই বরফ গলে গেলো ডান দিকের ছবিতে দেখো : বরফটাকে এক টুকরো লোহা বেঁধে পানির নিচে ধরে রাখা হয়েছে, ওপরে পানি টগবগ করে ফুটলেও নিচে বরফ একেবারেই রয়ে গেলো, গললো না

দেখবে পানি বেয়ে তাপ নিচের থেকে ওপরের দিকে তরতর করে এগোয়, কিন্তু ওপর থেকে নিচের দিকে মোটেই তা নয় নিচ থেকে তাপ দিলে নিচের থেকে পানি গরম হয়ে হালকা হয়ে যায় আর সেই হালকা পানি গরমশুদ্ধ, ওপরে উঠে আসে এইভাবে নিচ থেকে যে-পানি ওপরে উঠে এলো তার জায়গা দখল করার জন্যে ঠাণ্ডা পানি ওপর থেকে নিচে নেমে যায়, আবার একটু পরে সেও গরম হয়ে ওপরে উঠে আসে এইভাবে তাপ যাবার রীতিকে বলে তাপ পরিচলন (convection) এটা তরল বা বায়বীয় পদার্থের বেলাতেই সম্ভব হয় তাহলে, তাপ পরিবহন আর তাপ পরিচলন দুয়ের মধ্যে তফাত কী? পরিবহনের বেলায় তাপ একটি অণু থেকে তার পাশের অণুতে, তারপর সেখান থেকে তার পাশের অণুতেএইভাবে বয়ে যায় ক্যারাম খেলবার সময় দেখেছে তো? স্টাইকার দিয়ে একসার ঘুটিকে তুমি ধাক্কা দিলে, ধাক্কা গিয়ে লাগলো সবার পেছনের ঘুটিটায়, সেই ঘুটিটা কিন্তু তার ঠিক আগের ঘুটিটাকে ধাক্কাটা পাচার করে দিলো, সে আবার পাচার করলো তার আগের ঘুটিটাকেএই ভাবে হাত বদল হতে হতে ধাক্কাটা শেষ পর্যন্ত পৌঁছলো সব সামনের ঘুটিটায়

তাপ পরিবহনের বেলায় অনেকটা এইভাবে এক অণু থেকে পাশের অণুতে হাত বদল হতে হতে তাপ এগিয়ে চলে আর তাপ পরিচলনের বেলায় খানিকটা গরম পদার্থ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় তাপ বয়ে নিয়ে যায় তাই, তাপ পরিবহনের বেলায় পদার্থের মধ্যকার অণুরা যে যার জায়গাতেই থাকে কিন্তু তাপ পরিচলনের সময় পদার্থের ভেতরকার অণুরা নড়াচড়া করেএকদল অণু এক জায়গা ছেড়ে আর এক জায়গায় যায়, যাবার সময় যেন বোঁচকা বেঁধে নিয়ে চলে তাপ

কিন্তু, প্রশ্ন হলো সূর্য থেকে পৃথিবীতে তাপ আসে কেমন করে? সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে তো কোনো ঘন-পদার্থও নেই, তরল বা বায়বীয় পদার্থও নেই যে তাপ পরিবহন বা তাপ পরিচলন সম্ভব হবে তাহলে মানতেই হবে, পরিবহন আর পরিচলন ছাড়াও আরো কোনো তৃতীয় রকম উপায় নিশ্চয়ই আছে, যার সাহায্যে তাপ যাওয়া-আসা করতে পারে এই তিন নম্বর উপায়টির নাম হলো তাপ বিকিরণ বা radiation তাপের পরিবহন আর পরিচলন হয় আস্তে আস্তে, কিন্তু বিকিরণ হয় ভীষণ বেগে এক সেকেণ্ডে ১৮৬০০০ মাইল বেগেওইটেই হলো আলোর গতি তাছাড়া, পরিবহন আর পরিচলনের বেলায় তাপ চলতে পারে একেবেঁকে, এলোমেলো ভাবেও, কিন্তু বিকিরণের বেলায় চলে একেবারে সোজা নাক বরাবর, যাকে বলে সরল রেখায়

আরো মজার ব্যাপার আছে?

বিকিরণের সময় তাপ একটা কিছুর মধ্যে দিয়ে চলে গেলো, অথচ সেই জিনিসটা একটুও গরম হলো না যেমন ধরো, পৃথিবী যে বায়ুমণ্ডল দিয়ে মোড়া রয়েছে তার সবচেয়ে বাইরের দিকটা ভীষণ ঠাণ্ডা তার মধ্যে দিয়ে সূর্য থেকে আসছে দারুণ তাপ অথচ, বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগটা যে-রকম ঠাণ্ডা সেই রকম ঠাণ্ডাই থেকে যায় যেন ভুতুড়ে ব্যাপার : বায়ু মণ্ডলের ভেতর দিয়ে তাপ চলে গেলো অথচ বায়ুমণ্ডল তা টেরও পেলো না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন