শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১

ইউক্লিড এর জীবনী - Euclid of Alexandria

ইউক্লিড এর জীবনী -  Euclid of Alexandria

ইউক্লিড এর জীবনী (আবির্ভাবকাল ৩০০ খ্রি. পূর্বাব্দ)

আমাদের স্কুলে, কলেজে আজ পর্যন্ত যে-ধরনের জ্যামিতি পড়ানো হয় তার অনেকগুলোরই আবিষ্কারক হলেন প্রাচীন অঙ্কশাস্ত্রবিদ ইউক্লিড (Euclid)। ইউক্লিডকে বলা হয় জ্যামিতির জনক (Father of Geometry)।  

ঈসা (আঃ) জন্মের ৩০০ বছর আগে যেসব জ্যামিতিক সূত্র প্রচলিত ছিলো তিনি সেগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। তিনি মোট ১৩ খণ্ডে এই সূত্রগুলো সংকলন করেন।

প্রবাদ আছে যে, ইউক্লিডের এই অঙ্কশাস্ত্রের গ্রন্থটি এতো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, প্রচারের দিক থেকে ইউরোপে বাইবেলের পরই হলো এর স্থান। ইউক্লিডের মৃত্যুর আড়াই হাজার বছর পরেও আজো স্কুলে, কলেজে যে-জ্যামিতিশাস্ত্র পড়ানো হয়, তারও মূল ভিত্তি ইউক্লিডেরই তত্ত্ব।

যদিও অঙ্কশাস্ত্রের এই প্রয়োজনীয় অংশটিকে আজো আমরা ধরে রেখেছি, কিন্তু যিনি এর স্রষ্টা, তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত হারিয়ে গেছে কালের অন্তরালে।

প্রচলিত আছে, ইউক্লিড মহাজ্ঞানী প্লেটোর স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। সেকালে এই স্কুল ছিলো খুবই বিখ্যাত, বিশেষ করে এই স্কুলের অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষার বিষয়টি ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক কারণে প্লেটোর এই অঙ্কশিক্ষার স্কুলটিকে স্থানান্তরিত করা হয় মিশরের প্রাচীন সমুদ্রবন্দর ও রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় (Alexandria)।

এই সময় আলেকজান্দ্রিয়ার সম্রাট ছিলেন টলেমি (Tolemy)। টলেমি নিজেও ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি কবি, শিল্পী, জ্যোতির্বিদ এবং অঙ্কশাস্ত্রবিদদেরকে খুব শ্রদ্ধা এবং সমাদর করতেন। তিনিই আলেকজান্দ্রিয়ায় স্থাপন করেছিলেন বিশাল এক গ্রন্থাগার। কথিত আছে, সম্রাট টলেমি স্থাপিত এই গ্রন্থাগারে প্রায় সাত লক্ষ গ্রন্থ ছিলো। এ ছিলো সত্যি এক বিস্ময়কর সংগ্রহ যা আজকের যুগেও এক দুঃসাধ্য কর্ম। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার সেই বিশাল ও বিস্ময়কর গ্রন্থাগারটি আজ কালের করাল গ্রাসে ধ্বংস হয়ে গেছে।

ইউক্লিড নিজেও এই বিশাল গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করতেন, গবেষণা করতেন। সারা মিশরে, এমনকি ইউরোপেও ছিলো তাঁর পাণ্ডিত্যের সুনাম। সবাই জানতো তাঁর অঙ্কশাস্ত্রের উপর গবেষণার কথা।

সেই সময় তাঁর অঙ্কশাস্ত্রের গ্রন্থগুলো প্রথমে আরবি ভাষায়ই রচিত হয়েছিলো। পরে দ্বাদশ শতাব্দীতে তাঁর গ্রন্থসমূহ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদের সময় নামকরণ করা হয় ইলিমেন্টস (Elements)।

এতে ছিলো মোট ১৩টি খণ্ড। এর প্রথম খণ্ডে আছে বিন্দু (Points), রেখা (Lines) বৃত্ত (Cricles), ত্রিভুজ (Triangles) ইত্যাদি।

তখনো তো কাগজ আবিষ্কৃত হয়নি। সমস্ত পুস্তকই ছিলো হস্তলিখিত। আর এই গ্রন্থ লেখা হতো মিশরের প্যাপিরাস (Papyrus) নামক গাছের পাতায়। তাই গাছের পাতায় হস্তলিখিত সাত লক্ষ গ্রন্থের সমাবেশ যে কি বিস্ময়কর কাজ ছিলো, তা আজ ভাবাও যায় না।

দ্বিতীয় খন্ডে আছে বীজগণিতের সাহায্যে জ্যামিতিক অঙ্কের সংখ্যা তৈরির পদ্ধতি। তৃতীয় এবং চতুর্থ খণ্ডে আছে বৃত্তবিষয়ক বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে আছে অনুপাত, ভগ্নাংশ এবং তাদের বাস্তব পরীক্ষা। একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ খণ্ডে আছে বিশুদ্ধ জ্যামিতির সমস্যা ও তার সমাধান। এই বইতে আছে ঘনফল, পিরামিড, অষ্টভুজের ক্ষেত্রফল এবং যৌগিক বিষয়ে আলোচনা। ইউক্লিড শুধু এগুলোর সংগ্রহ এবং সম্পাদনাই করেননি, সেখানে নিজস্ব মত ও তত্ত্বও সংযোজন করেছেন। তৈরি করেছেন তাঁর নিজস্ব গাণিতিক পদ্ধতি। এগুলোর বিশেষত্ব এই যে, এখানে সেই আদি যুগ থেকে শুরু করে ইউক্লিডের যুগ পর্যন্ত জ্যামিতিশাস্ত্রের একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।

কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করতেন এই জ্যামিতিগ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করার জন্য মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটল তাঁকে নির্দেশ এবং অনুপ্রেরণা দান করেছিলেন। তাঁর আদেশেই ইউক্লিড এই জটিল কাজে হাত দেন এবং তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। কিন্তু আধুনিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, কারো আদেশে নয়, ইউক্লিড তাঁর নিজের মনের অনুপ্রেরণাতেই বেছে নিয়েছিলেন এই বিশাল কর্মটি।

আজ এই গ্রন্থ বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রচারিত হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। পরবর্তীকালে বিশ্বের জ্ঞানী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরাও ইউক্লিডের জ্যামিতির সূত্র অবলম্বনেই তাঁদের গবেষণা করেছেন আবিষ্কার করেছেন অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক সূত্র। ইউক্লিডের উপর গবেষণা করতে করতেই বিখ্যাত জার্মান অঙ্কশাস্ত্রবিদ রেইম্যান (Rieman) আবিষ্কার করেন ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রি (Euclidian Geometry)।

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনও ইউক্লিডের জ্যামিতির সূত্রের সাহায্যেই আবিষ্কার করেছেন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব (Relativity)। এ ছাড়াও আইনস্টাইন ছিলেন ইউক্লিডের একান্ত ভক্ত এবং তাঁর ভাবশিষ্য। তিনি ইউক্লিডের উপর অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং গবেষণাও করেছেন। মহাজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে ইউক্লিড ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অঙ্কশাস্ত্রবিদ। তিনিই জ্যামিতিশাস্ত্রের সত্যিকার সূত্র আবিষ্কার করে গেছেন।

ইউক্লিডের জ্যামিতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোকতকগুলো ব্যাপার বিনা প্রমাণে মেনে নিতে হবে। তাদের বলা হয় স্বতঃসিদ্ধ । অথাৎ এগুলো ধ্রুব সত্য। অঙ্ক দিয়ে এর কোনো প্রমাণ দেওয়া যাবে না, অর্থাৎ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। যেমন : ইউক্লিডের একটি সিদ্ধান্ত হলো---কোনো একটি সরল রেখার বহিঃস্থ কোনো বিন্দু থেকে একটিমাত্র সমান্তরাল সরলরেখা আঁকা যেতে পারে। ইউক্লিডে বলেন, z বিন্দুর ভেতর দিয়ে XY সরলরেখার সমান্তরাল একটিমাত্রই সরলরেখা আঁকা যায়। ইউক্লিড নিজেই এ ব্যাপারটির একটি যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।

পরবর্তীকালে অন্যান্য গণিতজ্ঞেরাও অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁরাও ইউক্লিডের মতোই ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে ইউক্লিডের সেই ধ্রুব সত্যগুলো ধ্রুবই রয়ে গেছে। 

ইউক্লিড এর জীবনী -  Euclid of Alexandria - গণিত কার্টুন
ইউক্লিড এর জীবনী -  Euclid of Alexandria - গণিত কার্টুন

 

অঙ্কশাস্ত্র বিষয়টি সত্যি খুব কাঠখোট্টা। কিন্তু এমন নীরস বিষয়ের প্রতিই প্রচণ্ড আগ্রহ ছিলো ইউক্লিডের। তিনি যখন জ্যামিতিশাস্ত্র নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রন্থ রচনা এবং গবেষণায় রত ছিলেন, তখন সারা দেশ জুড়ে তার ছিলো প্রচণ্ড খ্যাতি। এমনকি স্বয়ং সম্রাট টলেমিও ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ এবং অনুরাগী ভক্ত। তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে ইউক্লিডের কাছে এই কাঠখোট্টা জ্যামিতি শিখতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু জ্যামিতির জটিল তত্ত্ব তাঁর মাথায় সহজে ঢুকতো না। তাই তিনি একদিন ইউক্লিডকে বলে ফেলেছিলেন, আচ্ছা, আপনার বইয়ে জ্যামিতির সূত্র যেভাবে লিখেছেন, এর চেয়ে সহজভাবে লিখবার বা বোঝবার কোনো পথ নেই? সম্রাটের প্রশ্ন শুনে মহাজ্ঞানী ইউক্লিড সবিনয়ে বলেছিলেন,-না, মহারাজ। রাজাদের জন্যও জ্যমিতিতে কোনো সহজ উপায় তৈরি হয়নি। জ্ঞানার্জনের জন্য রাজকীয় পথ বলে কিছু নেই (In Geometry there is no shortcut for kings. There is, Sir, no royal road to learning)

ইউক্লিডের এই কথাটি ইতিহাসের পাতায় আজো অমর হয়ে আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন