বুধবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২২

উইলিয়াম হার্ভের জীবনী - William Harvey

 

উইলিয়াম হার্ভের জীবনী - William Harvey
উইলিয়াম হার্ভের জীবনী - William Harvey

উইলিয়াম হার্ভের জীবনী - William Harvey

উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)

উইলিয়াম হার্ভে (William Harvey) ষোড়শ শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকে শারীরিক অঙ্গসংস্থান এবং শারীরবৃত্তিয় বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি প্রাণীর দেহের হৃৎপিণ্ড এবং রক্তের সচলতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ করেন। তাঁর গবেষণায় এবং পরীক্ষায় মানবদেহের অঙ্গসংগঠনের বিন্যাস সম্পর্কিত বিদ্যা এক নতুন যুগে প্রবেশ করে।

তিনি প্রমাণ করেন যে, আমাদের হৃৎপিণ্ড (Heart) পাম্প করে ধমনীর মধ্য দিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশে রক্ত প্রেরণ করে। ধমনী আবার অনেকগুলো শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৈশিকনালীর সৃষ্টি করে। হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ধমনী ও তার শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে এই কৈশিক নালীতে পৌছায়। এরপর দুষিত রক্ত আবার শিরার সাহায্যে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। মানুষ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহে রক্ত-সংবহন প্রক্রিয়া চক্রাকারে হয়ে থাকে। হার্ভে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ লক্ষ করেছিলেন।

হার্ভে বলেছিলেন রক্ত শুধু হৃৎপিণ্ডের মধ্যেই নয়, এর বাইরে দেহের সর্বত্র ও সর্বদা একই দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া এক নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দেহের মধ্যে চক্রাকারে প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্বে দীর্ঘকাল থেকেই শারীরবৃত্ত তথা শরীরের রক্তসঞ্চালন সম্পর্কে প্রচলিত ছিলো ভ্রান্ত ধারণা। চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বের অ্যারিস্টটলীয় যুগ থেকে ধারণা প্রচলিত ছিলো যে, রক্তের প্রবাহ হয় বায়ুর ধাক্কায়। দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্তও ধারণা ছিলো হৃৎপিণ্ডে বায়ু প্রবিষ্ট হয় এবং তারই ধাক্কায় রক্তের প্রবাহ ঘটে।

সাগরে যেমন বায়ুর কারণে সাগরস্রোত প্রবাহিত হয় দেহের অভ্যন্তরেও তেমনি বায়ুর প্রবাহেই রক্তের সঞ্চালন ঘটে। পরবর্তীতে মুসলিম বিজ্ঞানী আন নাফিস এই ব্যাপারে সর্বপ্রথম সঠিক ধারণা দেন। উইলিয়াম আহার্ভে আরো পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেন।  

[কে প্রথম রক্ত সঞ্চালন এর সঠিক ধারণা দেন সেই ব্যপারে বিতর্ক নিয়ে নিবন্ধ - লিংক]

হার্ভের জন্ম হয়েছিলো ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল ইংল্যান্ডের কেন্টের (Kent) ফকস্টোন (Folkestone) নামক শহরে। তাঁর পিতা থমাস হার্ভে (Thomes Harvey) ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি।

হার্ভেরা ছিলেন নয় ভাইবোন। এর মধ্যে উইলিয়াম হার্ভে ছিলেন সবার বড় এবং আরো মজার ব্যাপার হলো, এই নয় ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র বড় ভাই উইলিয়ামই শিক্ষাদীক্ষায় জ্ঞানে-গরিমায় শীর্ষস্থানে আরোহণ করেছিলেন। অন্য কোনো ভাইবোন জীবনে কেউই শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় হতে পারেননি। তবে শিক্ষায় উন্নতি না করলেও ব্যবসা করে প্রত্যেকে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছিলেন।

উইলিয়াম হার্ভের বাল্যজীবন সম্পর্কে খুব একটা বেশিকিছু জানা যায় না। কেন্ট প্রদেশের গ্রামাঞ্চলেই কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। ১৫৮৮ থেকে ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করেছেন ক্যান্টারবারির (Canterbury) কাছাকাছি কিংস স্কুলে (Kings School)। এরপর ১৬ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি এসে ভর্তি হন ক্যাম্ব্রিজের কনভিল (Conville) এবং কাইসাস কলেজে (Caisus College)। এখানে তিনি পড়াশোনায় কৃতিত্বের জন্য বৃত্তি লাভ করেন। তাঁর ছিলো ডাক্তারি পড়ার দিকে প্রবল ঝোঁক। ছাত্রও ভালো ছিলেন। তবুও পড়াশোনায় খুব একটা এগোতে পারেননি। ১৫৯৮ থেকে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি শারীরিক অসুস্থতার জন্য কলেজেই যেতে পারেননি। বি. এ. ডিগ্রী লাভ করেছিলেন ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে। এরপর তিনি ইউরোপের বিখ্যাত মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় পাডুয়া (Padua) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ডাক্তারি পড়ার জন্য। এটা ছিলো আড়াই বছরের কোর্স। ডাক্তারি পড়ার সময়েই তিনি হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াকলাপ এবং রক্তসঞ্চালনের উপর বিস্তর অধ্যয়ন করেন। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিপ্লোমা লাভ করেন। তারপর ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে।

লন্ডনে এসে তিনি উচ্চতর ও বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভর্তি হন লন্ডনের কলেজ অব ফিজিশিয়ানসে (College of Physicians)। এই কলেজ থেকে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং নিজ দায়িত্বে রোগীর চিকিৎসা করার প্রাথমিক অনুমোদন লাভ করেন। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই পরীক্ষা পাসের পরই তিনি পুরোপুরি ডাক্তার বলে স্বীকৃতি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পরই তিনি ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর পরিবারিক চিকিৎসক মি. ল্যান্সলট ব্রাউনী (Lancelot Browne)-র কন্যা এলিজাবেথ ব্রাউনী (Elizabeth Browne)-কে বিয়ে করেন।

বিয়ের পরপরই তিনি শ্বশুরের সহায়তায় প্যারিসে কলেজ অব ফিজিশিয়ানসের কাছে একটি বাসা নেন। এখানে বাসা নেয়ার পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিলো তার। আশা ছিলো শ্বশুর যেহেতু প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাই তার সুপারিশে হয়তো কলেজে একটি চাকরিও জুটে যেতে পারে। পরে অবশ্য ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজে একটি ফেলোশিপ পেয়ে যান। ফেলোশিপ পাওয়ার পর সেন্ট বার্থোলোমিউস (St. Bartholomews) এবং সেন্ট থমাসস (St. Thomas's) নামে দুটো হাসপাতালের যে-কোনো একটিতে চাকরি পাওয়ার পথ সুগম হয়।  

উইলিয়ামের ছোটো ভাই জন (John) ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে রাজা প্রথম জেমস-এর ঘনিষ্ঠ হন। পরে তিনিই রাজাকে ধরে বড় ভাইয়ের জন্য একটি সুপারিশ যোগাড় করেন। পরে রাজার সুপারিশে উইলিয়াম হার্ভে সেন্ট বার্থোলোমিউস হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এ হাসপাতালে সহকারী ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু যিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, কয়েকমাস পরেই তিনি মারা যান। উইলিয়াম হার্ভে সে শূন্যপদে সমাসীন হন। উইলিয়াম হার্ভে যখন সেন্ট বার্থোলোমিউস হাসপাতালে যোগদান করেন তখন এটি ছিলো ১২ ওয়ার্ডবিশিষ্ট ২০০ শয্যার একটি মাঝারি সাইজের হাসপাতাল। এই সময় উইলিয়াম হার্ভে সর্বমোট বেতন পেতেন বছরে ৩৫ পাউন্ড। তিনি এই হাসপাতালে মোট ৩৪ বছর একটানা চাকরি করেছেন। তারপর ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে অলিভার ক্রমওয়েল (Oliver Cromwell) ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

তাঁর এই দীর্ঘ চাকরিজীবনে তিনি বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণাও করেছেন এবং হাসপাতালের বাঁধাধরা কাজের পরেও ব্যক্তিগতভাবে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির চিকিৎসা করেছেন। এঁদের মধ্যে স্যার ফ্রান্সিস বেকন (Sir Francis Bacon)-এর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন। এরপর তাঁর হাত দিয়েই তিনি ১৬১৮ জন ডাক্তার তৈরি করেছেন। চাকরি-জীবনে তিনি সারা ইংল্যান্ডে একজন বিশ্বস্ত ডাক্তার বলে পরিচিত ছিলেন। তবে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মানবদেহের রক্তসঞ্চালনের উপর প্রচলিত ধারার বিপরীতে নিজস্ব মতবাদ দিতে গিয়ে তিনি বেশ কিছুটা সমালোচনার সম্মুখীন হন। তবু ডাক্তার হিসেবে তার যশ ও জনপ্রিয়তার কোনো ঘাটতি হয়নি।

১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রথম জেমস খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজকীয় ডাক্তার স্যার থিওড়োর টুরকোয়েট ডি মেয়ার্ন (Sir Theodore Turqeuet de Mayerne) ছিলেন দেশের বাইরে। অতঃপর হাতের কাছে বিশ্বস্ত ডাক্তার উইলিয়াম হার্ভেকে ডাকা হলো। হার্ভে তার সহকারীদের নিয়ে প্রচণ্ড চেষ্টাও করলেন রাজাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু পারলেন না।

কিন্তু রাজার মৃত্যুর পর এই বলে গুজব রটে গেলো যে, রাজাকে তাঁরই এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ডিউক অব বাকিংহাম (Duke of Bakingham) বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করেছেন। উইলিয়াম হার্ভেই তার চিকিৎসা করার সময় এই তথ্য জানতে পারেন। পরে ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টে এর বিচার দাবি করা হয়। এই বিচারের প্রধান সাক্ষী ছিলেন উইলিয়াম হার্ভে। বিচারের তদন্তে হার্ভের অনুমান সত্যে পরিণত হয়েছিলো।

প্রথম জেমস-এর মৃত্যুর পর রাজা হন প্রথম চার্লস (Charles-1)। রাজা প্রথম চার্লসেরও অগাধ শ্রদ্ধা ছিলো হার্ভের প্রতি। তিনি হার্ভেকে রাজপরিবারের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করেন। তারপর প্রয়াত রাজার প্রতি শেষ চিকিৎসা করতে গিয়ে হার্ভে যে দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তার স্বীকৃতিস্বরূপও তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়। উইলিয়াম হার্ভে প্রথম চার্লসের স্বাস্থ্যও সর্বক্ষণ যত্নসহকারে দেখতেন। রাজার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত চার্লসের স্বাস্থ্য ছিলো অটুট।

এমনি করেই তিনি রাজা প্রথম চার্লসের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হন। চার্লস দুবার স্কটল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। এই দুবারই উইলিয়াম হার্ভে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে সাথে ছিলেন। প্রথম চার্লস ডাক্তার উইলিয়াম হার্ভেকে সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করতেন। গবেষণা চালানোর জন্য রাজা তার নিজের বাগানের হরিণ তাঁকে দিতেন প্রয়োজনে প্রথমে কোনো পশুর উপর পরীক্ষা করার জন্য। তিনি শুধু রাজপরিবারের চিকিৎসকই ছিলেন না, কলেজ অব ফিজিশিয়ানসেরও গরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন ছিলেন। কলেজের যে কোনো কাজই তাকে বাদ দিয়ে হতো না। কলেজের সভাপতির পরেই ছিলো তাঁর আসন। পেশাগত দায়িত্ব ছাড়াও তিনি  নিয়োজিত থাকতেন বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। তিনি গবেষণা করতেন মূলত হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপ এবং রক্তসঞ্চালনের গতি প্রকৃতির উপর। তিনি ক্ষুদ্রতম প্রাণী কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী জীব এবং মানুষের দেহেও নিয়ত পরীক্ষা চালাতেন। কোন প্রাণীর রক্ত কিভাবে দেহের অভ্যন্তরে সঞ্চালিত হয় তার পরীক্ষা করতেন।

গৃহযুদ্ধের সময় রাজা প্রথম চার্লসের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলে তার উপরে নেমে আসে বিপর্যয়। বিপ্লবীরা তাঁর গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে। তাই আজ আর জানার উপায় নেই তিনি কি পদ্ধতিতে গবেষণা করতেন, গবেষণার কি ধারা তিনি ব্যবহার করতেন- সকল প্রমাণপত্র বিনষ্ট করে ফেলে তারা। উইলিয়াম হার্ভে কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশে যে বক্তৃতা দিতেন তাঁর কিছু কিছু এখানো আছে। তার সমস্তগুলো একত্র করে লেকচার অন দি হোল অব অ্যানাটমি (Lecture on the whole of Anatomy) নামে ব্রিটিশ যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এগুলোরও অধিকাংশ অসম্পূর্ণ। এগুলোতে দেহের কঙ্কালের গঠন, কোষের গঠন সম্পর্কে যা বলা হয়েছিলো তার অংশটুকু নেই।

উইলিয়াম হার্ভে পূর্বপ্রচলিত ধারণাকে বাতিল করে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেই চিকিৎসা করতেন। প্রাচীন অ্যারিস্টটলীয় ধারণার বিরোধিতা করে তিনি দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেন নিজস্ব অভিজ্ঞতাপ্রসূত মতবাদ। প্রাণীদেহের রক্তসঞ্চালনের উপর তার মতবাদ প্রথমে তিনি সহযোগীদের কাছে ব্যক্ত করতেন, পরে ক্লাসে ছাত্রদেরও মুখে মুখে বলতেন। তারপরই তিনি এ বিষয়ে তৈরি করতে থাকেন তার প্রমাণপত্র এবং লিখিত বক্তব্য। একটানা বারো বছর প্রচেষ্টার পরে তিনি প্রকাশ করেন একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ-অন দি মোশন অব দি হার্ট অ্যান্ড ব্লাড ইন অ্যানিম্যালস (On the Motion of The Heart and Blood in Animals)। তাঁর এ বইটি কিন্তু সারা ইউরোপে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁকে পরিচিত করে তোলে সর্বত্র। এই বইতে তিনি দেহের রক্তসঞ্চালনের উপর সঠিক তথ্য প্রদান করেন।

একদিকে যেমন তাঁকে বইটি এনে দেয় প্রশংসা, তেমনি অপর দিকে একটি দল তার প্রতি বিক্ষুব্ধও হয়। যারা তখনো অ্যারিস্টটলীয় ও গ্যালেনের মতবাদের প্রতি অন্ধবিশ্বাসী ছিলেন, তারা সহজে মেনে নিতে পারেননি এই নতুন মতবাদ।। এই বিরুদ্ধবাদীদের দলে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ছিলেন ফ্রান্সের শারীরতত্ত্ববিদ জীন রিয়লান (Jean Riolan)। তিনি হার্ভের গ্রন্থের তীব্র সমালোচনা করেন এবং দীর্ঘ দিনের প্রতিষ্ঠিত সত্যের (?) বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর জন্য হার্ভেকে অভিযুক্ত করেন। হার্ভে তাঁর সাথে কোনোরকম বাগযুদ্ধে যাননি। তিনি জীন রিয়লান সাহেবের সমালোচনার জবাব দিয়ে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থ প্রণয়ন করেন  এবং এই পুস্তিকার মাধ্যমেই সমালোচনাকারীদের প্রত্যেকের অভিযোগের জবাব দেন।

ইংল্যান্ডে ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই হার্ভে রাজা চার্লসের সাথে ছিলেন। যখন চার্লস তাঁর হেডকোয়ার্টার অক্সফোর্ডে স্থানান্তর করেন। তখনো তিনি রাজার সাথেই ছিলেন। তিনি তখন মারটন কলেজের (Merton College) দায়িত্বে ছিলেন। এরপর গৃহযুদ্ধের শেষে রাজা চার্লস যখন পরাজিত হন তখনো হার্ভে ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। কিন্তু বিপ্লবী সৈন্যরা তাঁকে রাজার পাশে থাকতে দেয়নি। জোর করে সরিয়ে দেয়া হয় তাঁকে।

হার্ভে কখনো রাজনীতি করতেন না। তবু রাজার প্রতি তাঁর একটা মমত্ববোধ ছিলো। তারপর যখন রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সে খবর শুনে তিনি ভয়ানক ভেঙে পড়লেন, যদিও মূখ ফুটে কিছু বলার ছিলো না। এর দুবছর পর তিনি প্রকাশ করেন তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ Anatomical Excitations Concerning the generation of living Creatures. তিনি মুরগির ডিম দিয়ে জীবনের বিবর্তনধারাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।

হার্ভের ভাই তখন ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন, কিন্তু হার্ভে তেমন অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি। তিনি অর্থের দিকে না গিয়ে নিমগ্ন ছিলেন গবেষণা নিয়ে। কিন্তু এরপরও তাঁর শেষ জীবনে নেমে এলো আরো দুর্ভোগ। যেহেতু রাজা চার্লসের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো, তাই ক্রমওয়েল সরকার তাঁকে দালাল আখ্যা দিয়েছিলো। তাঁকে আর প্রবেশ করতে দেওয়া হলো না শহরে। তিনি শহরের বাইরে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন ভাইদের আশ্রয়ে। এমনকি তিনি কলেজ অব ফিজিশিয়ানের কাজেও যেতে পারতেন না। তাঁর নিজের কিছু গবেষণাপত্র ছিলো, তা তিনি দান করে দেন কলেজে। কিন্তু তাও ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে এক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই দুঃসহ জীবন-যাপন করে তিনি অবশেষে ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন এক ভাইয়ের বাড়িতে গলগ্রহ অবস্থায় করুণ অবহেলায় মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি মারা গেলেও তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা আজো তাঁকে অমর করে রেখেছে বিশ্বের দরবারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন