বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের গল্প - The story of the discovery of penicillin by Alexander Fleming

 

বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের গল্প,The story of the discovery of penicillin by Alexander Fleming

বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের গল্প - The story of the discovery of penicillin by Alexander Fleming

পেনিসিলিন এর নাম শুনেন নাই শিক্ষিত সমাজে এমন লোক খুজে পাওয়া কঠিন। এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়,  যে কোন পরিবারে,  কোন না কোন সময়ে বিভিন্ন জীবাণু ঘটিত রোগে এই পেনিসিলিন সাফল্যের সাথেই ব্যাবহার হয়ে আসছে। বহু দুরারোগ্য জীবাণু ঘটিত রোগে,  যেমন---নিউমোনিয়া, সিফিলিস, মেনিনজাইটিস, ডিপথেরিয়া ইত্যাদি রোগ দমনে ভালোই দক্ষতা দেখিয়ে আসছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই করিতকর্মা ওষুধটি আবিষ্কৃত হয়েছে একেবারেই আকষ্কিক ভাবে।
আজ এই পেনিসিলিন এর আবিষ্কারের ঘটনা নিয়েই আলোচনাঃ
এটি আবিষ্কার করেন লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালের এক ডাক্তার ----নাম তার আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং ---১৯২৮ সালে। পরে অবশ্য তিনি বিশ্ব জোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। নাইট উপাধি এবং নোবেল পুরস্কার সহ আরো বহু পুরস্কার ও সম্মানজনক উপাধি লাভ করেন এই যুগান্তকারি আবিষ্কারের জন্যে। এই আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন ধারার জন্ম হয়।
ফ্লেমিং সেন্ট মেরী হাসপাতালের মেডিক্যাল স্কুলটিতে ছাত্র পড়াতেন আর অবসর সময়ে চিকিৎসা বিষয়ে গবেষনা করতেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি মিলিটারিতে যোগ দিয়ে ফ্রান্স এ চলে যান। সেখানে তার কাজ ছিলো ভালো কোন এন্টিসেপ্টিক বা বিজবারক বের করা। কেননা এটির অভাব ছিল তখন। কিন্তু অনেক চেষ্টা চালিয়েও তিনি ভালো কোন এন্টিসেপ্টিক আবিষ্কার করতে পারলেন না। যা মানব দেহের কোন ক্ষতি না করে মারবে শুধু মাত্র জীবাণু গুলোকে।
যুদ্ধ শেষ হলে তিনি তার আগের হাসপাতাল টিতে ফিরে আসলেন। কিন্তু ভুলতে পারলেন না ফ্রান্সে থাকাকালীন তার অসহায় অবস্থার কথা। চারপাশে তার আহত সৈনিকরা বিষাক্ত ক্ষত নিয়ে কাতরাচ্ছে, মরছে, কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না এইসব হতভাগাদের জন্যে। তাই তিনি লন্ডনে ফিরে এসে ছাত্র পড়ানোর ফাকে ফাকে চালিয়ে যেতে লাগলেন তার গবেষণা। বিভিন্ন জিনিস নিয়ে তিনি গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার গবেষণার বস্তু থেকে বাদ যায়নি চোখের পানি,
  মুখের লালা, এমনকি ডিমের কুসুমও। ডিমের সাদা অংশে তিনি একটি এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, সেটি ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংশ না করে, শরীরের প্রয়োজনিয় জীবাণু গুলো মেরে ফেলে।
১৯২১ সাল থেকে ১৯২৮
  সাল পর্যন্ত তিনি কিছুই করতে পারলেন না,  তবে ইতোমধ্যে তার পদোন্নতি হয়েছে। তিনি তখন হাসপাতালের একটি টিকাদান কেন্দ্রের পরিচালক, আর স্ট্যাফাইলোকক্কাস (Staphylococcus এক প্রকার জীবাণু) বিশেষজ্ঞ। এরা এমন জীবাণু যারা আক্রান্ত স্থানে পুজ তৈরী করে, মেরুদন্ড,  রক্ত, হৃদপিন্ড ইত্যাদিতে সংক্রামক রোগ সৃস্টিতে সক্ষম।
স্বভাবতই
  তার কাছে এক পুস্তক প্রকাশকের একটি পত্র আসলো। যার মূল বিষয়বস্ত হল প্রকাশক সাহেব একটি ডাক্তারি বই প্রকাশ করছেন, সেটিতে Staphylococcus সংক্রান্ত অধ্যায়টি তার  লিখে দিতে হবে। ফ্লেমিং স্বীকৃতি জানিয়ে চিঠির জবাব দিলেন।
চিঠির সুত্রে যে যোগাযোগ সেটিও একটি অবিস্মরণীয়/ঐতিহাসিক
  ঘটনা। কেননা যে আবিষ্কার এর  জন্যে ফ্লেমিং এর নাম চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে, তার সুত্রপাত মূলত এখান থেকেই। এটি এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ছিলো না, ছিলো মামুলি এক অনুরোধ পত্র মাত্র।
ফ্লেমিং যখন ঐ অধ্যায় টি লিখার কাজে হাত দিয়েছেন,
 তখন স্ট্যাফাইলোকক্কাস জীবাণু সম্পর্কে তিনি জানতে পারলেন এক আজব খবর। খবরটি হল কোন কোন পরিস্থিতিতে বা অবস্থা বিপাকে ঐসব জীবাণুর অবস্থা  নাকি পুরোপুরি পাল্টে যায়। ফ্লেমিং এর কাছে ব্যাপার টি খুব আশ্চর্যজনক, অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক মনে হল। তাই তিনি নিজে একটু যাচাই করে দেখতে চাইলেন, এই বিষয়ে লিখার আগে। লিখার কাজ স্তগিত রেখে শুরু করলেন পরিক্ষার পালা।
১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কালচার প্লেটে জীবাণুর চাষ করতে লাগলেন। আর ক্রমেই তার টেবিলটি
  ভরে উঠতে লাগলো কালচার প্লেটের স্তুপে। তিনি মাঝে মাঝেই প্লেট তুলে দেখেন তার জীবাণু গুলোর আকৃতি পাল্টে গেছে কিনা। এমনি ভাবে পুরনো একটি প্লেট নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে তার মেজাজ  গেল বিগড়ে। চিৎকার করে বললেন, ড্যাম, দিয়েছে তো সবকিছু বরবাদ করে।
কাকে তিনি অভিশাপ দিলেন? না কোন মানুষকে নয়। আসলে অপরাধী ছিলো পেনিসিলিয়াম গোত্রের একটি মোল্ড। কখন যে কোন সুযোগে কালচার প্লেটের মধ্যে মোল্ডটির বীজরেণূ
  ঢুকে পড়ে। সেখানেই দিব্যি গজিয়ে আর বংশবৃদ্ধি করে, বরবাদ করে দিয়েছে আসল জীবাণুর বৃদ্ধি।
এমনি অঘটন অবস্য প্রায়ই ঘটে কালচার প্লেটে। আর যারা জীবাণু নিয়ে কাজ করেন, তাদেরকে এইসব অবাঞ্চিত অণুজীবদের দৌড়াত্ব সহ্য করতে হয় মুখ বুজে। বিশেষ করে সেই সব দিনে, যখন ল্যাবরেটরি গুলো আজকের মত ঝকঝকে, তকতকে ছিলো না। আর এদিক থেকে বলতে গেলে ফ্লেমিং এর ল্যাবরেটরি ছিলো আদর্শস্থানীয়। সেটি ছিলো অনেকটা অন্ধকার, অপরিচ্ছন্ন, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিতে পরিপুর্ণ।

কালচার প্লেটে এই ধরনের ঘটনা  ঘটলে করনীয় হল, সবকিছু ফেলে দিয়ে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার ও নির্বীজিত (sterilized) করে সেটিতে পুনরায় জীবাণু চাষের ব্যবস্থা করা। ফ্লেমিং ও তাই করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কি ভেবে তিনি আবার একবার প্লেটটির দেখলেন। এটি একটি দৈব ঘটনা।

বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের গল্প,The story of the discovery of penicillin by Alexander Fleming

 

২য় বার তিনি না দেখলে আর পেনিসিলিন এর অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষমতা আবিষ্কার হত না। আর এই পেনিসিলিন এর হাত ধরেই পরবর্তী কালে আবিষ্কার হয় আরো অনেক এন্টিবায়োটিক। এবার তিনি প্লেট এ তাকিয়ে বিষ্ময়ে  হতবাক হয়ে গেলেন। যেসব জায়গায় পেনিসিলিয়াম এর মোল্ড জন্মেছে, সে সব জায়গায় যেন কোন মন্ত্রবলে  জীবাণুর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় তো প্লেট ঝকঝকে  পরিষ্কার দেখাচ্ছে। ব্যাপার টি ফ্লেমিং কে রীতিমত ভাবিয়ে তুলল, কেননা তিনি ফ্রান্স থেকে  ফিরে এসে ভালো কোন জীবাণুনাশক এর সন্ধানেই ছিলেন। ভাবলেন মোল্ড গুলো কি তাহলে এমন কোন বিষ তৈরী করে, যা staphylococcus জীবাণুর বৃদ্ধি বন্ধ করে বা ধ্বংশ করে!!! অন্য কোন জীবাণুকেও কি এটি ধ্বংস করতে পারে??? তাহলে তো যে কোন রোগের ক্ষেত্রেই এটি ব্যাবহার করা যেতে পারে!
যেই মোল্ড গুলো একটু আগে তার মনে জাগিয়েছিলো চরম বিরক্তি,
  এখন তিনি সেগুলোই সযত্নে লালন -পালন করতে লাগলেন। এই বার মাংশের স্যুপে সেটির বংশবৃদ্ধি করে, দিনের পর দিন সেটির আচরন পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। খেয়াল করলেন পেনিসিলিয়াম এর মোল্ড গুলো থেকে এক প্রকার হলুদ রঙ এর দ্রব্য ফোটায় ফোটায় বেরিয়ে আসে,  যা মাংশ কেও রাঙিয়ে দেয়। পরীক্ষা করে দেখলেন এই হলুদ রঙ এর জিনিসটির অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা। পানি মিশিয়ে একে ৮০০ গুন লঘু করলেও এর জীবাণুনাশক ক্ষমতা একটুও কমে না। স্ট্যাফাইলোকক্কাস,  স্ট্রেপটোকক্কাস, ছাড়াও নিউমোনিয়া, গণোরিয়া,  মেনিনজাইটিস প্রভৃতি রোগের জীবাণু অনায়াসেই মেরে ফেলে। বিভিন্ন রুগ্ন প্রাণীর দেহে ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রবেশ করিয়ে ভালো ফল লাভ করলেন। পেনিসিলিয়াম গোত্রের মোল্ড থেকে পাওয়া যায় বলে নাম দিলেন পেনিসিলিন।
তবে,
 তার দুর্ভাগ্য নানা অসুবিধার জন্যে তিনি পেনিসিলিন কে ওষুধ হিসেবে মানুষের ওপর ব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে পারেন নি। বিশুদ্ধ পেনিসিলিন তৈরীতে সক্ষম হননি বলে কোন ডাক্তারও এটি মানুষের উপর ব্যবহারের সাহস পাননি।
বিশুদ্ধ পেনিসিলিন তৈরীতে সক্ষম না হলেও তিনি অনেক চেষ্ঠা করেছিলেন। বিজ্ঞানিদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন। ডাক্তারদের সভায় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সবই ব্যার্থ। ব্যার্থ হলেও তিনি আশা ছাড়েন নি। ল্যাবরেটরি তে পেনিসিলিয়াম নোটেটাম
 এর চাষ চালিয়ে গেছেন। তবে দীর্ঘ ১১ বছর পরে পুনরায় কাজ শুরু হয়। এই কাজের পুরোভাগে ছিলেন ড. ফ্লুরি আর ড. চেইন। তারা যেমন পেনিসিলিন কে বিশুদ্ধ করতে সক্ষম হন, তেমনি কম খরচে পেনিসিলিন উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
অনেকেই ভাবতে পারেন তাহলে বিজ্ঞানী ফ্লেমিং এর কি অবদান তাহলে।!!!
 

জি বিরাট অবদান আসলে অন্য জায়গায়, যেহেতু পেনিসিলিয়াম এর  মোল্ড থেকে যদি এমন অমোঘ ঔষধ পাওয়া যায়, তাহলে মাটির বুকে তো অনেক ছত্রাক,  জীবাণু বা অন্য কোন ক্ষুদ্র উদ্ভিদ এর মোল্ড পাওয়া যায়, যেগুলো হয়তো পেনিসিলিয়াম এর থেকেও শক্তিশালী হবে।
ফ্লেমিং এর এই আবিষ্কার তাই বিজ্ঞানীদের উদ্ভুদ্ধ করলো, মাটির বুকের নতুন নতুন মাইক্রো অর্গানিজম বা অনুজীব ও ছত্রাক নিয়ে গবেষনার। গবেষনার মাধ্যমে অচিরেই বেরিয়ে আসত লাগলো,
 নানা অনুজীব থেকে বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের ঔষধ। ড. ফ্লেমিং এর এই আকষ্মিক আবিষ্কার ই উন্মোচন করলো অনুজীব বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্তের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন