সায়েন্স ফিকশন,অনুবাদ গল্প,Science Fiction,বিজ্ঞান কল্পকাহিনী,রে ব্রাডবুরি,Ray Bradbury |
অনুবাদ গল্প – সায়েন্স ফিকশন - মহানগর – রে ব্রাডবুরি - Ray Bradbury
মহানগরটি অপেক্ষা করছে কুড়ি হাজার বছর ধরে। মহাশূন্যে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে গ্রহটি, মাঠে ফুটছে ফুল আবার ঝরে যাচ্ছে, তবু অপেক্ষা করে রয়েছে মহানগর। গ্রহটির নদীগুলো কুলুকুলু ধারায় বইছে, শুকিয়ে যাচ্ছে একসময়, মিশে যাচ্ছে ধুলোয়। তবুও অপেক্ষার পালা শেষ হয় না মহানগরটির। তাজা বাতাস হয়ে আসছে আঁশটে, আকাশের ঘেঁড়া মেঘগুলো একাকী ভেসে বেড়ায় অলস সাদায়। তবু প্রতীক্ষার প্রহর গুণে চলে মহানগর।
মহানগরটি অপেক্ষা করছে তার জানালা, কালো আগ্নেয় শিলার দেয়াল আর আকাশ ছোঁয়া উঁচু ইমারত নিয়ে। তার রাস্তা সর্বদা জনমানবশূন্য, দরজার হাতলে বহু কাল কারও হাতের স্পর্শ পড়েনি। মহানগর অপেক্ষা করছে তখনও যখন গ্রহটি তার নীলচে-সাদা সূর্যের কক্ষপথে আবর্তন করছে, পার হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ঋতু, বরফ রূপান্তরিত হচ্ছে আগুনে, আবার ফিরে যাচ্ছে বরফের চেহারায়, তারপর পরিণত হচ্ছে সবুজ মাঠে
এবং হলুদ গ্রীষ্মের তৃণভূমিতে।
কুড়ি হাজার বছর পরে, এক গ্রীষ্মের বিকেলে অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটল মহানগরের।
আকাশের পটভুমে উদয় হলো একটি রকেট।
মাথার অনেক ওপরে ভেসে বেড়াল রকেট, পাক খেল, আবার ফিরে এল, অবতরণ করল আগ্নেয় পাথরের তৈরি দেয়াল থেকে পঞ্চাশ গজ দূরের নরম শিলার জমিনে।
পাতলা ঘাসে শোনা গেল বুট পরা জুতোর শব্দ এবং মনুষ্য কণ্ঠ। কেউ কাউকে ডাকছে।
‘রেডি?’
‘অলরাইট, মেন। সাবধান! সবাই শহরে প্রবেশ করবে। জেনসেন, তুমি এবং হাচিসন সবার আগে থাকবে। পাহারা দেবে, চোখ-কান খোলা রেখো।’
কালো দেয়ালের মাঝে মহানগরের লুকানো নাক খুলে গেল, শরীরের গভীরে কোথাও গুপ্ত একটি সাকশন ভেন্ট থেকে ফুউউশ করে বেরিয়ে এল বাতাস। মিশে গেল বাইরের গরম হাওয়ায়।
‘আগুনের গন্ধ, ছিটকে পড়া ধূমকেতুর মত গন্ধ, গরম ধাতব। অন্যভুবন থেকে একটি জাহাজ এসেছে। পিতলের গন্ধ, পোড়া পাউডারের গন্ধ, সালফার, রকেটের গন্ধকের গন্ধ।’
এ তথ্যগুলো টেপে ফুটল। টেপ আটকানো চাকাঅলা সুটের সঙ্গে। হলুদ চাকাঅলা খাঁজ বেয়ে খবর পেীছে গেল অন্যান্য মেশিনে।।
(ক্লিক-ক্লিক-চাক-চাক)
একটি ক্যালকুলেটর মেটরনম বা তাল নির্দেশ করার যন্ত্রের মত শব্দ করল। পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়। ন'জন লোক! একটি টাইপরাইটার তাৎক্ষণিকভাবে এ মেসেজটি ফুটিয়ে তুলল টেপে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল টেপের লেখা।
(ক্লিকিটি-ক্লিকচাক-চাক)। ওদের রাবারের বুটের শব্দ শোনার অপেক্ষা করছে মহানগর। মহানগরের নাকের ফুটো আবার প্রসারিত হলো।
মাখনের গন্ধ। মহানগরের মনে পড়ে গেল কুড়ি হাজার বছর আগে সে গন্ধ পেত দুধ, পনির, আইসক্রিম এবং মাখনের।
(ক্লিক-ক্লিক) ‘সবাই, সাবধান!’
‘জোনস, তোমার অস্ত্র বের করে রাখো। বোকামি কোরো না।'
‘শহরটা তো মৃত; তা হলে ভয় কীসের? কে জানে এটা জীবিত নাকি মৃত!’ লোকের কথা কানে যেতে কান খাড়া করল মহানগর। শতাব্দীর পর শতাব্দী সে শুধু শুনেছে বাতাস বইবার আবছা শব্দ, গাছ থেকে পাতা খসে পড়ার আওয়াজ। এবারে মানুষের গলা শুনতে পেয়ে জং ধরা কানে তেল লাগাল মহানগর যাতে কণ্ঠগুলো পরিষ্কার শুনতে পায়। কান কথা শুনছে, নাক গন্ধ নিচ্ছে।
বাতাসে ভীত মানুষের ঘামের গন্ধ। বগলে ঘামের গন্ধ। তাদের হাতে ধরা অস্ত্রের ঘাম।
নাক গন্ধ শুকছে। ক্লিক-ক্লিক-চাক-ক্লিক।
তথ্য পৌছে গেল প্যারানাল চেক টেপে। ঘাম ক্লোরাইড, সালফেট, ইউরিয়া, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন-আর নানান কিসিমের গন্ধ।
অকস্মাৎ ঘণ্টা বাজার শব্দে চমকে উঠল ছোট দলটি। বিরাট কানজোড়া শুনল:
‘আমাদের বোধহয় রকেটে ফিরে যাওয়া উচিত, ক্যাপ্টেন।’
‘অর্ডার আমি দেব, মি.স্মিথ।’
‘জী, স্যার।’
‘এই যে, তুমি! পেট্রন! কিছু চোখে পড়ল?’
‘না, স্যার। মনে হচ্ছে এখানকার সবকিছু বহু আগেই মরে সাফ হয়ে গেছে।’
‘দেখলে তো, স্মিথ! ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তবে জানি না কেন। এরকম ভুতুড়ে জায়গা আর কখনও দেখেছেন? শহরটাও কেমন পরিচিত ঠেকছে। মনে হচ্ছে এর ছবি আগে কোথায় যেন দেখেছি!’
‘বোকার মত কথা বোলো না। এ গ্রহ পৃথিবী থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে। এখানে এর আগে কোনদিন আসিনি আমরা।’
‘কিন্তু আমার গা-টা কেমন ছমছম করছে, সার। মনে হচ্ছে রকেটে ফিরে গেলেই ভাল হত।’
মিলিয়ে এল পায়ের শব্দ। বাতাসে কেবল অনুপ্রবেশকারীদের নিঃশ্বাসের শব্দ। কান শব্দগুলো শুনল এবং মহানগরের শরীর কাজ শুরু করে দিল দ্রুত। ঘুরতে শুরু করল রোটর ব্লেড, ভালব এবং প্লেয়ারের মাঝ দিয়ে ঢুকল তরল পদার্থ। একটু পরে শহরের মস্ত দেয়ালের বিরাট ফুটো অর্থাৎ নাক এবং কানের ছিদ্র দিয়ে বের করে দিল তাজা বাতাস।
‘গন্ধ পাচ্ছ, স্মিথ! আহ, সবুজ ঘাসের গন্ধ! ইস্, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু গন্ধ নিতে ইচ্ছে করছে।’
অদৃশ্য ক্লোরোফিল প্রবাহিত হলো লোকগুলোর গায়ে।
‘আহহ!’ পায়ের শব্দ আগের মতই শোনা যাচ্ছে। ‘গন্ধটা খারাপ নয়, কী বলো, স্মিথ? এসো।’
মহানগরের কান এবং নাকের পেশীতে ঢিল পড়ল। উদ্দেশ সফল হয়েছে। দাবার গুটি পছন্দসই জায়গায় এগোচ্ছে। এবারে মহানগরের চোখে জমে থাকা কুয়াশা আর বাপের মেঘ উড়ে গেল।
‘ক্যাপ্টেন, জানালা!’
‘কী?'
‘ওই জানালাগুলো। ওগুলোকে আমি নড়তে দেখেছি।’
‘কই আমি তো কিছু দেখলাম না!’
‘জানালাগুলো নড়াচড়া করেছে। বদলে ফেলেছে রং। গাঢ় থেকে হালকা হয়েছে রং।’
‘কি আমার কাছে তো এগুলো সাধারণ চৌকোনা জানালা বলেই মনে হচ্ছে।’
আবছা জিনিসগুলোর ওপর দৃষ্টি দিল মহানগর। শহরের মেকানিকাল খাদের মধ্যে পড়ে থাকা অয়েল শ্যাকগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠল, ব্যালান্স হুইল ডুব দিল সবুজ তেলের পুকুরে। জানালার ফ্রেমগুলো ফুলে উঠল। চকচক করে উঠল জানালা।
নীচে, রাস্তায়, দু’জন লোক হাঁটছে। তাদের পেছনে আরও সাতজনের একটা দল। এদের পরনের ইউনিফর্মের রঙ সাদা, মুখগুলো গোলাপি, যেন চড় মেরে রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে; চোখের রঙ নীল। শিরদাঁড়া টানটান করে, পেছনের পায়ে ভর করে হাঁটছে তারা, হাতে ধাতব অস্ত্র। পায়ে বুটজুতো। এরা সবকটা পুরুষ।
কেঁপে উঠল জানালা। সরু হয়ে এল জানালা। যেন অগ্নিগোলকের মধ্যে মোচড় খেল অসংখ্য চোখ।
‘ক্যাপ্টেন, বিশ্বাস করুন, ওগুলো সত্যিকারের জানালা নয়!’
‘আহ্, হাঁটো তো।’
‘আমি ফিরে যাচ্ছি, সার।’
‘কী?'
‘আমি রকেটে ফিরছি।’
‘মি. স্মিথ?’
‘আমি কোনও ফাদে পা দিতে চাই না!’
‘একটা শূন্য শহরকে ভয় পাচ্ছ?’ অন্যরা হেসে উঠল। তবে নিপ্রাণ হাসি।
‘হাসো, হাসো!’
পাথরের রাস্তা। তিন ইঞ্চি চওড়া, ছয় ইঞ্চি লম্বা পাথুরে ব্লক কেটে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। রাস্তাটি অনুপ্রবেশকারীদের শরীরের ওজন মাপল।
একটি মেশিন সেলারে একটি লাল লাঠি স্পর্শ করল একটি সংখ্যা: ১৭৮ পাউও...২১০, ১৫৪, ২০১, ১৯৮-প্রতিটি লোকের গায়ের ওজন রেকর্ড হয়ে গেল যন্ত্রে।
মহানগর এখন পুরোপুরি জেগে উঠেছে!
ভেন্ট বা ফোকর এখন বাতাস টানছে এবং বের করে দিচ্ছে। বাতাসে অনুপ্রবেশকারীদের মুখের তামাকের গন্ধ, হাতে সাবানের গন্ধ। এমনকী তাদের চোখের মণিরও রয়েছে সূক্ষ্ম গন্ধ। মহানগর গন্ধগুলো চিহ্নিত করতে পারছে, এবং এ তথ্য দিয়ে লোকগুলো সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যাচ্ছে। চকচকে জানালাগুলো চমকাচ্ছে। মহানগরের শ্রবণেন্দ্রিয় এড়িয়ে যেতে পারছে না সূক্ষ্মতম কোনও আওয়াজও। লোকগুলোর হৃদস্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে সে। ওদেরকে সে দেখছে, পরীক্ষা করছে।
রাস্তাগুলো যেন মহানগরের জিভ, লোকগুলো হেঁটে যাচ্ছে, তাদের জুতোর স্বাদ গ্রহণ করছে রাস্তা, পাথরের সূক্ষ্ম রন্ধ্রের মাঝ দিয়ে ঢুকে গেল ওটা, লিটমাস পেপারে পরীক্ষা করা হলো স্বাদের নমুনা। এই নমুনার সঙ্গে মানুষগুলোর অন্যান্য নমুনা যোগ করা হলো। এখন চূড়ান্ত বিশ্লেষণের অপেক্ষা।
পায়ের শব্দ আসছে। দৌড়াচ্ছে কেউ।
‘ফিরে এসো, স্মিথ।’
‘না, জাহান্নামে যান আপনি।’
‘ওকে তোমরা ধরো।’ ছুটে আসছে পায়ের আওয়াজ।
এবারে চূড়ান্ত পরীক্ষা। মহানগর শুনেছে, দেখেছে, স্বাদ নিয়েছে, অনুভব করেছে, ওজন মেপেছে, ব্যালান্স করেছে, এখন শেষ কাজটি বাকি।
রাস্তার মাঝখানটায় হঠাৎ একটা গর্তের সৃষ্টি হলো। ক্যাপ্টেন ছুটতে গিয়ে সেই গর্তের মধ্যে পড়ে গেলেন। কেউ দেখল না তাকে গ্রাস করেছে রাস্তা।
একটা ধারাল ফলা এগিয়ে এল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে, আরেকটা ঢুকে গেল তার বুকে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর পেট ফেড়ে বের করে আনা হলো নাড়িভূঁড়ি। রাস্তার নীচে, লুকানো একটি প্রকোষ্ঠে, টেবিলের ওপর শুইয়ে দেয়া হলো ক্যাপ্টেনের লাশ। ক্রিস্টালের প্রকাণ্ড মাইক্রোস্কোপ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রক্তাক্ত পেশীর দিকে, আঙুল ঢুকে গেল তখনও ধক ধ্ক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডে। ক্যাপ্টেনের গা থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হলো ছাল চামড়া, টুকরো টুকরো করে কাটা হলো দেহ।
রাস্তার ওপরে লোকগুলো তখনও ছুটছে। দৌড়াচ্ছে স্মিথ, চেঁচাচ্ছে তার সঙ্গের লোকগুলো। স্মিথও পাল্টা চিক্কার দিল। আর রাস্তার, নীচের গোপন কক্ষে বিভিন্ন মাইক্রোস্কোপের স্লাইডের নীচে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ক্যাপ্টেনের খণ্ডিত লাশ। মাইক্রোস্কোপ পরীক্ষা করে দেখছে ওগুলো। ক্যাপ্টেনের রক্ত নেয়া হচ্ছে ক্যাপসুল ভর্তি করে। কাউন্ট করা হচ্ছে, মাপা হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা, সতেরোটি খণ্ডে টুকরো করা হলো হৃৎপিণ্ড, দ্বিখণ্ডিত হলো লিভার এবং কিডনি। মগজের মধ্যে ঢোকানো হলো ড্রিল মেশিন, বের করে আনা হলো ব্রেন। সুইচবোর্ডটা থেকে নষ্ট তার টেনে বের করার মত ক্যাপ্টেনের শরীরের শিরাগুলো বের করে আনা হলো। অবশেষে অবসান ঘটল পরীক্ষার।
এরা মানুষ। এরা বহু দূরের এক জগৎ থেকে এসেছে, নির্দিষ্ট একটি গ্রহে এদের নিবাস, এদের রয়েছে নির্দিষ্ট চোখ, কান, তারা পায়ের ওপর ভর করে বিশেষ একটি ভঙ্গিমায় হাঁটে এবং সঙ্গে বহন করে অস্ত্র। তারা চিন্তা করতে পারে, পারে লড়াই করতে এবং এদের বিশেষ হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যা আছে এসব কিছুই বহুদিন আগে রেকর্ড করা হয়েছে।
রাস্তার ওপরে লোকগুলো রকেটের দিকে ছুটছে। দৌড়াচ্ছে স্মিথ।
এরা আমাদের শত্রু। এদেরকে নাগালে পাবার জন্যই গত কুড়ি হাজার বছর ধরে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এ লোকগুলোর ওপর প্রতিশোধ নিতে আমরা আকুল হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছিলাম। সব খাপে খাপে মিলে গেছে। এ লোকগুলো এসেছে পৃথিবী নামের একটি গ্রহ থেকে। এরা কুড়ি হাজার বছর আগে টাওলানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এরা আমাদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছিল এবং এক মহামারী ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ মহামারীর কবল থেকে বাঁচার জন্য তারা আরেকটি গ্যালাক্সিতে পালিয়ে যায়। ততদিনে আমাদের গ্রহটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। কারণ মানুষগুলো আমাদের সব কিছু লুঠ করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তারা ওই যুদ্ধ এবং ওই সময়টাকে ভুলে গেছে, বিস্মৃত হয়েছে আমাদের কথা। কিন্তু আমরা ওদেরকে ভুলিনি। এরা আমাদের শত্রু। আমরা ওদেরকে অবশেষে বাগে পেয়েছি। আমাদের অপেক্ষার পালা সাঙ্গ হয়েছে।
‘স্মিথ, ফিরে এসো!’
রাস্তার নীচের গোপন কুঠরির লাল টেবিলের ওপর ক্যাপ্টেনের খণ্ড বিখণ্ড লাশে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে। দেহের দুই পাশে গজিয়ে গেল একজোড়া নতুন হাত। শরীরের ভেতরে তামা, পিতল, রূপা, অ্যালুমিনিয়াম, রাবার এবং সিক্ত দিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গগুলো দ্রুত তৈরি হয়ে গেল। মাকড়সার জাল দিয়ে শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হলো ছাল ছাড়ানো চামড়া, স্থাপিত হলো নতুন হৃৎপিণ্ড, খুলির মধ্যে বসল প্লাটিনাম ব্রেন। এ ব্রেন বা মগজ থেকে মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে নীলচে আগুনের ফুলিঙ্গ। তার দিয়ে হাত এবং পা সেলাই করে দেয়া হলো। সেলাই করা হলো ঘাড়, গলা এবং খুলি-নিখুঁত নতুন একটি শরীর তৈরি হয়ে গেল অবিশ্বাস্য দ্রুততম সময়ে।
টেবিলে উঠে বসলেন ক্যাপ্টেন, হাতের পেশি ফোলালেন। ‘থামো!’
রাস্তায় আবার হাজির হয়েছেন ক্যাপ্টেন, পিস্তল তুলেই তিনি গুলি করলেন।
গুলিতে এফোঁড় ওফোড় কলজে নিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল স্মিথ।
অন্যরা ঘুরে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ওদের দিকে দৌড়ে গেলেন।
‘ওটা একটা গাধা! শহর ভয় পায়!’ ওরা পায়ের নীচে পড়ে থাকা স্মিথের নিথর শরীরে তাকাল।
তারপর তারা তাদের ক্যাপ্টেনের দিকে মুখ তুলে চাইল। সরু হয়ে এল চাউনি।
‘আমার কথা শোনো,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘তোমাদের সঙ্গে আমার খুব জরুরী কিছু কথা আছে।’
মহানগর তার সমস্ত ক্ষমতা ও সামর্থ্য ব্যয় করেছে একজনকে রক্ষা করার জন্য, তাকে দিয়ে কথা বলানোর ক্ষমতা দিতে। তবে ভেতরে পুঞ্জীভূত ঘৃণা এবং ক্রোধ থাকলেও সে শান্তস্বরে কথা বলল।
‘আমি আর তোমাদের ক্যাপ্টেন নই,' বললেন ক্যাপ্টেন। ‘এমনকী আমি মানুষও নই।
এক কদম পিছিয়ে গেল লোকগুলো।
‘আমি মহানগর,’ বলে হাসলেন তিনি।
‘আমি দুশো শতক ধরে অপেক্ষা করেছি,' বললেন তিনি। ‘আমি অপেক্ষা করেছি পুত্রদের পুত্রদের পুত্ররা কবে ফিরে আসবে সে জন্য।'
‘ক্যাপ্টেন, সার!’
‘আমাকে বলতে দাও। আমাকে অর্থাৎ এ মহানগরকে কে তৈরি করেছে? আমাকে যারা তৈরি করেছে তারা মারা গেছে। সেই প্রাচীন জাতি একসময় এখানে বাস করত। আর এই মানুষগুলোকে পৃথিবীর লোকেরা ভয়ংকর এক মহামারীর মধ্যে ফেলে রেখে চলে যায়। সেই প্রাচীন জাতি স্বপ্ন দেখত পৃথিবীর মানুষ আবার ফিরে আসবে, তাদেরকে উদ্ধার করবে। কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। এই মহানগরকে তৈরি করা হয়েছিল ব্যালান্সিং মেশিন হিসেবে, এর আছে লিটমাস পেপার এবং একটি অ্যান্টেনা যার সাহায্যে ভবিষ্যতের সব মহাশূন্য ভ্রমণকারীকে সে পরীক্ষা করে দেখতে পারত। গত কুড়ি হাজার বছরে মাত্র দুটি রকেট এসে এখানে অবতরণ করে। একটি বহু দূরের গ্যালাক্সি ইনট থেকে। ওই স্পেস ক্রাফটের অভিযাত্রীদের পরীক্ষা করা হয় ওজন নেয়া হয়। কিন্তু মহানগরের মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছে না দেখে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় শিপের অভিযাত্রীরাও এভাবে রেহাই পেয়ে যায়। কিন্তু আজ। দীর্ঘদিন বাদে তোমরা এলে। এবারে প্রতিশোধ গ্রহণের পালা। দুইশো শতক আগে এ শহরের মানুষগুলো মারা গেছে, কিন্তু তারা একটি মহানগর রেখে গেছে তোমাদেরকে স্বাগত জানাতে।’
‘ক্যাপ্টেন, সার, আপনার শরীর বোধহয় ঠিক নেই। আপনি বরং শিপে এসে একটু বিশ্রাম করুন, সার।’
দুলে উঠল মহানগর।
দুই ভাগ হয়ে গেল রাস্তা। প্রকাণ্ড গর্তের মধ্যে ঝুপঝুপ করে পড়ে গেল লোকগুলো চিৎকার করতে করতে। গর্তের মধ্যে ছিটকে পড়ছে, দেখল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব ধারাল ফলা ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।
কিছুক্ষণ পরে। রোল কল শুরু হলো:
‘স্মিথ?’
‘এই যে আছি।'
‘জেনসেন?’
‘হাজির।’
‘জোনস, হাচিসন, স্প্রিগার?’
‘হাজির, হাজির, হাজির। সবাই মিলে দাঁড়াল রকেটের দরজায়।’
‘আমরা এক্ষুণি ফিরে যাব পৃথিবীতে।’
‘জ্বী, সার!’
এদের সবার ঘাড়ের পেছনে প্রায় অদৃশ্য একটা করে কাটা দাগ আছে, তাদের হৃৎপিণ্ড পেতলের তৈরি, প্রত্যঙ্গগুলো রুপোর এবং শিরাগুলো বানানো হয়েছে সোনালি, সূক্ষ্ম তার দিয়ে। তাদের মগজে মৃদু ইলেকট্রিক গুঞ্জন চলছে।
‘ডাবল মার্চ।’
নয়জন লোক দ্রুত মহামারীর সোনালি রঙের বোমাগুলো এনে ঢোকাল রকেটে।
‘এগুলো পৃথিবীতে ফেলতে হবে।’
‘জী, স্যার!’
রকেটের ভালভ সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। রকেট লাফ দিয়ে উঠে পড়ল শূন্যে।।
রকেটের গর্জন প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছে, মহানগর শরীর এলিয়ে দিল সমভূমির গায়ে। তার কাচের মত চোখগুলোর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এল। শিথিল হলো শ্রবণেন্দ্রিয়, নাকের প্রকাণ্ড ছিদ্রগুলো বুজে এল, রাস্তাগুলোকে আর কারও ওজন নিতে হবে মা। আর লুকানো যন্ত্রপাতিগুলো ডুব দিল তেলের মধ্যে।
আকাশে রকেটটা এখন ফুটকির মত লাগছে।
ধীরে ধীরে, আনন্দের সঙ্গে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে করতে মহানগর ভাবল, আহ্, মরণ কত সুখের!
মূঃ রে ব্রাডবুরি অনুবাদ: অনীশ দাস অপু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন